সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা অকার্যকর, মূল্যায়নে কতোটা ?
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরীঃ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীদের বের করে আনা। সেটা ঠিক কতটা আমরা পারছি, তার কোনো গবেষণা বা সার্ভে নেই। শিক্ষাদানের মাধ্যমে না পারছি জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে, না পারছি নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সক্ষমতা শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তুলতে। শিক্ষায় আনন্দ তখনই সম্পৃক্ত হয়, যখন শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। সেক্ষেত্রে সফলতার চেয়ে বিফলতা বেশি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্টিশীলতার চেয়ে মুখস্থবিদ্যাকে প্রাধান্য দেওয়াতেই এমনটা ঘটেছে-যেটি স্বয়ং বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেনে নিতে পারেননি। তিনি তার শিক্ষা দর্শন থেকে বলেছেন, ‘ইস্কুল বলিতে আমরা যাহা বুঝি সে একটা শিক্ষা দিবার কল। মাস্টার এ কারখানার একটা অংশ। সাড়ে দশটার সময় ঘণ্টা বাজাইয়া কারখানা খোলে। কল চলিতে আরম্ভ হয়, মাস্টারেরও মুখ চলিতে থাকে। চারটের সময় কারখানা বন্ধ হয়, মাস্টার-কলও তখন মুখ বন্ধ করেন, ছাত্ররা দুই-চার পাত কলে ছাঁটা বিদ্যা লইয়া বাড়ি ফেরে। তার পর পরীক্ষার সময় এ বিদ্যার যাচাই হইয়া তাহার ওপরে মার্কা পড়িয়া যায়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘দশটা হইতে চারটে পর্যন্ত যাহা মুখস্থ করি, জীবনের সঙ্গে, চারিদিকের মানুষের সঙ্গে, ঘরের সঙ্গে তাহার মিল দেখিতে পাই না। এমন অবস্থায় বিদ্যালয় একটা এঞ্জিন মাত্র হইয়া থাকে; তাহা বস্তু জোগায়, প্রাণ জোগায় না।’
এ কথাগুলো এখনো পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যদিও শিক্ষাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত করে এখনো সেটাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়েই রেখে দেওয়া হয়েছে। মেধাবী আর ভালো ছাত্র যে এক নয়, এ বিষয়টি এখনো আমাদের কাছে কনফিউশন হিসাবে থেকে গেছে। আমাদের গতানুগতিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেলে সেটাকে আমরা মেধা হিসাবে বিবেচনা করছি; অথচ সেখানে মুখস্থবিদ্যার চেয়ে জ্ঞান থেকে অর্জিত চিন্তার প্রতিফলন বেশি ঘটছে কি না, তা ভেবে দেখছি না। এ একটি কারণেই প্রকৃত মেধাবী শিক্ষার্থীরা খারাপ ছাত্র ও মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী ছাত্ররা ভালো ছাত্র হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এর ব্যতিক্রম আছে, তবে ব্যতিক্রম কখনো উদাহরণ হতে পারে না। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করলে বা ফেল করলে সামাজিকভাবে তার ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়ছে। অথচ তার এ ফলাফলের কারণ বিশ্লেষণ ও সেখান থেকে উত্তরণের মোটিভেশন ও দর্শন আমাদের শিক্ষায় অনুপস্থিত। এ নিয়ে শিক্ষা গবেষণারও অভাব রয়েছে। ঠিক কোন কারণটি এমন বিপর্যয় ডেকে এনেছে-সেটা কি মেধার ঘাটতি, সেটা কি মুখস্থবিদ্যায় পারদর্শী না হওয়া, সেটা কি শিক্ষাব্যবস্থার গলদ, সেটা কি পরিবেশ, পরিস্থিতি, না অন্য কোনো উপাদান; তার কোনো বিচার-বিশ্লেষণ নেই। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় শিক্ষক ছিলেন, বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন, বিপ্লবীও ছিলেন। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে জীবন থেকে তিনি যে বাস্তব শিক্ষা নিয়েছিলেন, সেগুলো তার মধ্যে যেমন সৃজনশীলতা তৈরি করেছিল, ঠিক তেমনি দেশপ্রেম ও ত্যাগের মানসিকতা গড়েছিল। কেশব চন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত আলবার্ট স্কুল থেকে ১৮৭৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলেও বৃত্তি না পাওয়ার তার শিক্ষকরা হতাশ হলেও তিনি মনে করতেন, পরীক্ষার নম্বরই মানুষের জীবনের শেষ কথা নয়। যারা পরীক্ষায় ভালো করেছে, তারা অনেকেই পরবর্তী জীবনে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে গেছে। জীবনের ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য স্থির লক্ষ্য ও সুষ্ঠুভাবে অধ্যাবসায়ের সঙ্গে শিক্ষালাভ অনেক বেশি ফলপ্রদ।
শিক্ষাকে গবেষণানির্ভর ও বহুমাত্রিক করা দরকার। শিক্ষাকে গবেষণামুখী করতে হলে বর্তমান সময়ে বিশ্বে প্রযুক্তির যে বিষয়গুলোতে এখনো পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ বা সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে, সেগুলোকে কেস স্টাডি হিসাবে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে হবে। শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে এগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করলে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে কোন কোন ধরনের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। এ ধরনের গবেষণামুখী শিক্ষা শিক্ষার্থীদের নিজেদের চিন্তাকে কাজে লাগাতে আগ্রহী করে তুলবে। আবার এ চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের জন্য সবাই যে একইভাবে চিন্তা করবে তা নয়, চিন্তাধারায় ভিন্নতা থাকবে এবং শিক্ষা সেক্ষেত্রে চিন্তার বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সক্ষম হয়ে উঠবে। আগের দিনের মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক চিন্তাধারা গড়ে উঠেছিল। সময় যত গড়িয়েছে বহুমাত্রিকতার চর্চা ততই কমেছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটোর মতো মানুষ সব ধরনের জ্ঞানের চর্চা করেছেন, যদিও সেসময় প্রথাগত শিক্ষা বলতে কিছুই ছিল না। তারপরও কীভাবে তারা বহুমাত্রিকতার চর্চা করে গেছেন, সেই কৌশল ও পরিকল্পনাগুলো শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে।
সারা পৃথিবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে, তেমন শিক্ষা ব্যবস্থাই গড়ে তোলা দরকার। তবে অন্ধ অনুকরণ করা নয়; নিজেদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও আবহমানধারাকে বজায় রেখে সর্বোত্তম ও আধুনিক শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমেই শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার মেলবন্ধন ঘটাতে পারলে কল্পনাশক্তি তৈরি হয়, যা চিন্তাশক্তি তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মেধা চর্চা ও বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক চিন্তা থেকে বের করে এনে জ্ঞানকেন্দ্রিক ধারণা দ্বারা প্রভাবিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার মৃত্যু ঘটলেও জ্ঞানের মৃত্যু নেই।
পরীক্ষায় পাশ করা আর শিক্ষিত হওয়া যে এক নয়, তা নিয়েও এখন আমাদের ভাবতে হচ্ছে। অনেকে বলছেন, মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে, তত মানবিক গুণাবলি হারাচ্ছে। অথচ বিষয়টি বিপরীতভাবে ঘটার কথা ছিল। প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানবিক প্রগতির বিষয়টিকে শিক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করা দরকার। আমাদের দেশের কৃষক, শ্রমিক, মজুর, খেটে খাওয়া মানুষের তেমন উল্লেখ করার মতো কোনো প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও মানবিক গুণাবলি ও মানবিক প্রগতিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা অতি শিক্ষিত মানুষের চেয়ে এগিয়ে আছেন। রাষ্ট্রের উন্নয়নে তাদের অবদান, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম অতি শিক্ষিত মানুষদেরও হার মানিয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এ জায়গাটিতেই আমাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে প্রযুক্তির পরিবর্তন এত দ্রুত ঘটছে যে, প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে মানবিক গুণাবলি ও মানবিক প্রগতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অগোচরে থেকে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে মানবিক ধারণাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। তা না হলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উদ্দেশ্য সফল হবে না। মানুষের জন্য যদি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হয়, তবে মানুষকে বাদ দিয়ে শিল্পবিপ্লবের উৎকর্ষ ঘটানো সম্ভব নয়। অনেকে অনুমান করছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কারণে অটোমেশন মানুষের জায়গাগুলো দখল করে নেবে, তখন বেকারত্বের মতো সমস্যাগুলো তৈরি হবে। আবার এর বিপরীতে অনেকেই বলছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে যে নতুন নতুন সম্ভাবনা গড়ে উঠবে, তা আরও বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। এ ধরনের বিষয়গুলো শিক্ষার ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, তা আগে থেকেই ভেবে রাখতে হবে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সবাই শিক্ষক হতে পারেন না, কেউ কেউ মহান শিক্ষক হন। আমাদের শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কথা মন দিয়ে শোনার মতো কেউ নেই। শিক্ষার্থীদের ভেতরে জন্ম নেওয়া অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে যায়। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা নিজেদের কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারছে, শিক্ষা তাদের জন্য কতটা উপযোগী হচ্ছে, শিক্ষা তাদের মধ্যে চিন্তাশক্তি গড়ে তুলতে পারছে কি না, শিক্ষাকে তারা আনন্দের উৎস হিসাবে গ্রহণ করতে পারছে কি না, শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মানবিক উন্নয়ন ঘটছে কিনা-এসব নিয়ে কোনো গবেষণা নেই, বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা নেই। শিক্ষায় ফিডব্যাক সিস্টেম যে অতিগুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে, সে সংক্রান্ত কোনো বাস্তব উপাদান নেই।
আগের উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষায় প্রবেশ করার চেষ্টা করছি। এ ধরনের শিক্ষায় পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। বইয়ের চাপ কমিয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, সততা ও নৈতিকতার সমন্বিত প্রভাবের কথা বলা হচ্ছে। তবে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কতটুকু বজায় রাখা যাবে, সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন ধরনের উপাদানগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে ও সেগুলোকে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমানভাবে প্রদান করা যাবে কিনা, সেটিও একধরনের চ্যালেঞ্জ। শিক্ষকদের নতুন শিক্ষাব্যবস্থায় অভ্যস্ত করতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে; কিন্তু সেটি তারা কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবেন, তাও এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। স্মরণ রাখতে হবে, এর আগে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের বিকাশে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর কারণ হলো, সৃজনশীলতার প্রকৃত অর্থ না বুঝে এটি শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে। পাঠ্যবই পূর্ণাঙ্গ হওয়া দরকার-পাঠ্যবই পড়েই যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞান অর্জন করতে পারে। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে সহায়ক বই যুক্ত করে দেওয়ায় শিক্ষা বাণিজ্যিক রূপ ধারণ করলেও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। বরং সহায়ক বইগুলো শিক্ষার্থীদের মনের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহ তৈরি করছে। এসব প্রতিকূলতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার নতুন ধারণা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে সবার বিশ্বাস। বারবার শিক্ষার পরিবর্তন ঘটিয়ে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানোর ভয়ংকর খেলা থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে; তবেই শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হবে।
ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী: অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়