সিনেমার গল্প গল্পের সিনেমা
ফয়সাল আহমেদ।।
আধুনিক চলচ্চিত্র কেমন হবে, হচ্ছে বা হওয়া উচিত। এক দশকের বাংলাদেশের ছবির যদি তালিকা করা হয়, সেখানে পাঁচটি ভালো ছবির নাম পাওয়া কঠিন। কেন এই দৈন্যদশা? কেন ভালো ছবির এত অভাব? কেন নির্মাতা তার বিষয়বস্তু খুঁজে পাচ্ছেন না বা পেলেও নির্মাণে চলচ্চিত্রের ভাষা রপ্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? একটি চলচ্চিত্র কী ধরনের হবে সেটা নির্ভর করে তার নির্মাণের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের ওপর। যখন বাণিজ্যই প্রধান লক্ষ্য, তখন সেই চলচ্চিত্রের মধ্যে তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। চলচ্চিত্র নির্মাতা অবশ্যই দশ জনের চেয়ে ভিন্ন একজন মানুষ।
সবাই ছবি বানান না, কেউ কেউ বানান। যিনি বানান তিনি প্রথমেই ভাবেন, তিনি কী ছবি বানাবেন। তার বিষয়বস্তু কী হবে বা গল্পটি কী এবং কেন, কী তিনি বলতে চান। বাংলাদেশে প্রথম থেকেই মুখ ও মুখোশ, আনোয়ারার ধারাবাহিকতায় জহির রায়হান বা আমজাদ হোসেন, আলমগীর কবিরসহ অনেকেই সুন্দর বিষয়বস্তুর সুস্থ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন সাফল্যের সঙ্গে। সাহিত্যও উপজীব্য হয়েছেÑ আবু ইসহাক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মাহমুদুল হক, হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসও এসেছে চলচ্চিত্রে।
সাহিত্য, চলচ্চিত্রের গল্প বা ভাবনার একটি বড় সংস্থান হতে পারে, যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। সারা বিশ্বেই কালজয়ী সাহিত্য চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সাহিত্যের চলচ্চিত্রায়ণ নিয়ে পাঠক ও দর্শকের দ্বন্দ্ব বা বিতর্ক একটি পুরাতন বিষয়। পাঠক প্রেক্ষাগৃহে তার প্রিয় সাহিত্যের চিত্রায়ণ দেখে অসন্তুষ্ট হন প্রায়শই। তারা উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমগত ভিন্নতা বুঝতে ব্যর্থ হন এবং অনুধাবন করতে পারেন না যে বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী ও সত্যজিতের পথের পাঁচালী একই প্রেক্ষাপটে দুটি ভিন্ন শিল্পকর্ম।
অভিনেত্রী চম্পা বলেন, ‘বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে একসময় গল্পের বৈচিত্র্য ছিল। বৈচিত্র্যপূর্ণ সেসব গল্পের ছবিগুলো দর্শকদের প্রতিনিয়ত আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ইদানীং বাংলা সিনেমার গল্পে কোনো নতুনত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। মান্ধাতা আমলের ধ্যান-ধারণা থেকেই বেশির ভাগ নির্মাতা এখনো ছবি নির্মাণ করে যাচ্ছেন। ভালো গল্প একেবারে নেই বললেই চলে। রয়েছে মেধাবী নির্মাতার অভাবও, যা কিনা ভালো ছবির জন্য একটা বড় অন্তরায়।
আর এ কারণেই এখনকার বেশির ভাগ বাংলা সিনেমা সেই অর্থে দর্শক-হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারছে না।’ এখন যেসব সিনেমা নির্মিত হচ্ছে তার ৯৫ ভাগের গল্প এক রকম। ঘুরেফিরে একই প্রেমের কাহিনি। ১০০ সিনেমার মধ্যে যে ৫টি সিনেমা অন্যরকম হচ্ছে, সেগুলোই দর্শক দেখছে, হিট হচ্ছে।
কথাগুলো বললেন, গুণী চিত্রপরিচালক জাকির হোসেন রাজু। তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্রের মূল সংকট গল্প। ভালো কোনো গল্পের সিনেমা হচ্ছে না। দর্শক সিনেমায় গল্প দেখতে চান, নায়ক-নায়িকা নয়। আমাদের সিনেমায় গল্পের সংকট রয়েছে। অথচ আমাদের গল্প সংকট নেই। গল্পটা খুঁজে নেওয়ার মানসিকতার অভাব রয়েছে। চারপাশে লাখ লাখ গল্প রয়েছে।’
একটা সময় সৈয়দ শামসুল হক, কাজী আজিজ, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানসহ নানা বিশিষ্টজন ছবির গল্প লিখতেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে ভেবে বর্তমান সময়ের অনেক নির্মাতাই সিনিয়র লেখকদের কাছে গল্পের জন্য যান না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিত্রপরিচালক বলেন, দেশে গল্পকারের অভাব রয়েছে এটা সত্যি। তবে যারা আছেন তারা একটি গল্প লিখতে দিলে অনেক সময় লাগিয়ে দিচ্ছেন।
টাকাও বেশি নিচ্ছেন। তাই বাধ্য হয়ে বিদেশি গল্প বা ছবির অনুকরণ করতে হয়। আর প্রতিবছরই ছবি মুক্তির সংখ্যা কমছে। এর মধ্যে কাজ না করলে জীবন চলবে কী করে? পরিচালনার পাশাপাশি বেশকিছু ছবির চিত্রনাট্য করে প্রশংসা পেয়েছেন তৌকীর আহমেদ। তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে গল্প ও চিত্রনাট্য। এর পাশাপাশি ছবির নির্মাণও ভালো হতে হবে। বর্তমানে অনেক স্বাধীন নির্মাতা নিজেই সিনেমার গল্প বলতে চান।
সেক্ষেত্রে চিত্রনাট্য নিজে করেন। তবে সে বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে সিনেমার গল্পটি দর্শকদের দেখাতে হবে। গল্পের সংকট রয়েছে এবং তা কাটানোর জন্য চেষ্টা আমাদেরই তো করতে হবে। পরিচালনার পাশাপাশি ‘অস্তিত্ব আমার দেশ’, ‘জাগো’, ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ ছবিগুলোর গল্প ও চিত্রনাট্য করেছেন খিজির হায়াত খান। তিনি বলেন, আমি নিজেও ভালো এবং সময়োপযোগী চিত্রনাট্য লেখার চেষ্টা করছি।
সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে শতভাগ দর্শকের কাছাকাছি এখনো যেতে পারিনি। আমাদের দেশে গল্পকার ও স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাব রয়েছে। সিনেমার গল্প লেখা আর চিত্রনাট্য তৈরি করা দুটি আলাদা ব্যাপার। এ বিষয়ে দক্ষ লোক প্রয়োজন। উপযুক্ত ট্রেনিংও দরকার। সিনেমার চিত্রনাট্যের একটা ফরমেট রয়েছে। সেটা আমরা ফলো না করেই চিত্রনাট্য তৈরির চেষ্টা করছি। এ কারণে প্রতিনিয়ত দর্শক হারিয়ে ফেলছি বলে মনে হয় আমার।
চলচ্চিত্রেও আবর্জনার কোনো স্থান নেই। প্রতিবছর নির্মিত হচ্ছে হাজার হাজার চলচ্চিত্র, কিন্তু ভালো ছবির স্বল্পতা রয়েই যাচ্ছে। প্রচার এবং মার্কেটিংয়ের যুগে অনলাইন প্ল্যাটফরমগুলো ক্রাইম, থ্রিলার যৌনতাকে ভর করে বাণিজ্য করছে। রুচির আকালে দর্শকও মোহিত হচ্ছেন চোখবাঁধানো উপস্থাপনায় আর প্রচারে।
কিন্তু প্রকৃত চলচ্চিত্রের অভাব তাতে পূরণ হচ্ছে না। তাই নির্মাতাকে আবার ভাবতেই হবে কী বানাব, কেন বানাব, কীভাবে বানাব।