সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার স্বপ্নদ্রষ্টা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদঃ মহান মুক্তিযুদ্ধে কিশোর, শ্রমিক, মজুর, চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সরকারি-বেসরকারি আমলা, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক, নারী সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ও ত্যাগেই রচিত হয়েছিল বিজয়ের, গৌরবের ইতিহাস। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ার নেপথ্যে ছিলেন জাতির যেসব সূর্যসন্তান, তাদের মধ্যে চিকিৎসকেরা অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে যেখানে পাকবাহিনীর হাতে ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল মানবতা, সেখানে চিকিৎসকরা সেই বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সব মেধা ও শক্তি নিয়ে। তারা যেমন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন, তেমনি রণাঙ্গনের বাইরে আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষদেরকে অবিরত চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। যুদ্ধ মানেই রক্তপাত আর মৃত্যু। মৃত্যুর দুয়ার থেকে আহত সেনাদের ফিরিয়ে এনে আবারো রণক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে শত্রুর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়া বা নিরীহ কোনো মানুষের দুঃসহ ক্ষত সারিয়ে তাকে আবারো হাস্যোজ্জ্বল জীবন দান করতে পারেন চিকিৎসকেরাই। পৃথিবীর সব যুদ্ধেই চিকিৎসকরা বৈরী পরিবেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আহত মানুষকে সুস্থ করার মহান দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সেই ভীষণ সঙ্কটকালে সাহসী কিছু বাঙালি চিকিৎসক গণমানুষের সেবায় মহৎ উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন। সদ্য প্রয়াত ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। যিনি আমৃত্যু মানবসেবা এবং সত্য ও ন্যায় ন্যায্যতার সপক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। ভিন্নমতে অসহিষ্ণু বাংলাদেশে বলিষ্ঠ ও সাহসী উচ্চারণের জন্য ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বর্তমানে কমবেশি সবাই চিনতেন, জানতেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও জাতীয় রাজনীতিতে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হওয়ার তিনি ছিলেন বিরল উদাহরণ।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশ হাসপাতাল গড়ার কাহিনী তার একাত্তরের দিনগুলো এবং মুক্তিযুদ্ধের চিকিৎসা ইতিহাস বইয়ে বিবরণ রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাস্থ্যসেবা মূলত চার পর্যায়ে প্রদত্ত বা পরিচালিত হয়েছিল। এক. মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসকদের পরিচালনায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্য রাজধানী ও সীমান্তের সন্নিকটে স্থাপিত অস্থায়ী (ক্ষেত্রবিশেষে ভ্রাম্যমাণ) ক্যাম্প, ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালে। দুই. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সংগোপনে এবং চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রদত্ত ও পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা। তিন. বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধা ডাক্তারদের পরিচালনায় ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল বা ক্লিনিক। চার, ভারতের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে (বেশির ভাগই সীমান্তবর্তী এলাকায়)। মারাত্মকভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতের অভ্যন্তরে এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এবং বিজয়-উত্তর বাংলাদেশ সরকার বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অনেকেই চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সেই ক্রান্তিলগ্নে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত এক হাজারেরও বেশি চিকিৎসক মিলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (BMA-UK) গঠন করেন। চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা: এএইচ সায়েদুর রহমানকে এর সভাপতি করা হয়, সাধারণ সম্পাদক হন ভাস্কুলার সার্জন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মে মাসের শুরুর দিকে বিএমএ ডা: জাফরুল্লাহ এবং আরেকজন তরুণ চিকিৎসক ডা: এম এ মবিনকে ভারতের ত্রিপুরায় পাঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য। তারা দুজন প্রথমে মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন এবং পরে আহত মুক্তিযোদ্ধা ও ত্রিপুরায় উদ্বাস্তু বাঙালিদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করেন। ২নং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তম একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। সেক্টর কমান্ডার ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা: রথিন দত্তের কাছে সাহায্য চান যেন ত্রিপুরা রাজ্যে একটি অস্থায়ী হাসপাতাল স্থাপন করা হয় এবং এর দায়িত্ব মুক্তিবাহিনীর হাতে অর্পণ করা হয়। এই উদ্যোগ আগরতলার অন্যান্য হাসপাতালের ওপর ব্যাপক চাপ হ্রাস করতে পারবে। ডা: দত্ত ভারতীয় ক্ষমতাসীনদের সাথে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। ২নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন আখতার আহমেদ (পরবর্তীতে মেজর ও বীর প্রতীক) নামে সেনাবাহিনীর একজন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি এবং ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী মিলে ১০ মে গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। শুরুতে ঔষধপত্র বা অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদি বলতে কিছুই ছিল না। হাসপাতালটি স্থাপনের পর পাকবাহিনীর গোলার ভয়ে কয়েকবার স্থানান্তর করতে হয়। মেলাঘর থেকে সোনামুড়া, শেষ পর্যন্ত আগরতলার কাছাকাছি বিশ্রামগঞ্জের হাবুল ব্যানার্জির লিচুবাগানে হাসপাতালটি স্থিত হয়। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী হাবলু ব্যানার্জি বাংলাদেশ হাসপাতালের জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তার শখের লিচু বাগান।
এই জায়গাটাই পরে একটু পরিবর্তন-পরিবর্ধন করে বাঁশ, কাঠ ও শন দিয়ে ২০০ শয্যার বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল নির্মিত হয় ২৬ আগস্ট। হাসপাতালটি ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হসপিটাল’, ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস হসপিটাল’ বা শুধু ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ডা: এম এ মবিন লন্ডন প্রবাসী বাঙালিদের সহায়তায় হাসপাতালের জন্য অর্থ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। ডা: সিতারা বেগম হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পান। ছন ও বাঁশের বেড়া দিয়ে শেষমেশ এটি হয়েছিল ৪৮০ বেডের হাসপাতাল ও অপারেশন থিয়েটার। হাসপাতালটি বাঁশ ও ছন বেড়ার তৈরি হলেও এর অপারেশন থিয়েটারে অনেক বড় ছিল যেখানে জটিল অপারেশন করা যেত।
ফিল্ড হাসপাতালে ডা: মোবিন, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মেজর আখতার আহমেদ, সিতারা বেগম ছাড়াও বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন। যেমন- ডা: কিরণ সরকার দেবনাথ, ডা: ফারুক মাহমুদ, ডা: নাজিমুদ্দিন, ডা: মোর্শেদ, বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে। বেগম সুফিয়া কামালের দুই কন্যা সুলতানা কামাল ও সাইদা কামাল, ইডেন কলেজের শিক্ষক জাকিয়া, মিসেস হামিদুল্লাহ, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী ডালিয়া, আসমা আলম, রেশমা আলম, পদ্মা রহমান, নীলিমা বৈদ্য, মিনু বিল্লাহ, সবিতা, শামসুদ্দীন প্রমুখ টিমে যোগ দেন।। সে সময় যেহেতু কোনো নার্স ছিল না, ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবী মহিলাদেরকে প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে অনেক মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এবং স্কুল-কলেজের সাধারণ মেয়েরা হাসপাতালে যোগ দিতে থাকেন। স্থানীয় বেশ কয়েকজন নার্স ও কম্পাউন্ডার এই হাসপাতালের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
সুলতানা কামালের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে সেই সময়ের কথা- ‘আমাদের কোনো ট্রেনিং ছিল না। আর আমরা নার্সিং কিংবা চিকিৎসার কিছু বুঝতামই না। কিন্তু একটা আবেগ ছিল। আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী, আমার বোন সাইদা চিত্রশিল্পী, মিনু আপা নৃত্যশিল্পী কিন্তু আমরা আবেগের কারণে প্রশিক্ষিত নার্সদের মতোই ৯ মাস সেবার কাজ করেছি।’ প্রশিক্ষিত নার্স পদ্মা রহমান বলেন, ‘আসলে আমরাও মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, একাত্তরে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র, তবে এটি মারণাস্ত্র ছিল না। ছিল সেবার অস্ত্র।’
শেষ পর্যন্ত হাসপাতালটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। হাসপাতালের স্বেচ্ছাকর্মী সুলতানা কামাল এর কারণ হিসেবে লিখেছেন-
‘ওরা ভেবেছিল, যুদ্ধ যখন চরমভাবে সামনাসামনি হবে, তখন তো অনেক আহত হবে। এটি সামাল দেয়া আর্মি ছাড়া সম্ভব নয় বলে ওদের ধারণা। এই হাসপাতাল গঠনে ত্রিপুরাবাসীর ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।’
এটি প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অনেকটা বৃদ্ধি পায়। ৯ মাসের যুদ্ধকালে বহু আহত মুক্তিযোদ্ধাকে এখানে চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলা হয়। ত্রিপুরার সীমান্ত দেশের কুমিল্লা জেলার খুবই কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা আর উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি এই এলাকার বাঙালি রোগীরাও সহজেই চিকিৎসা নিতে পারতেন। যুদ্ধের সময় অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে হাসপাতালটি। বাংলাদেশ এর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে এ হাসপাতালের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ডা: জাফরুল্লাহ তার অসমাপ্ত এফআরসিএস পূর্ণ করার জন্য বিলাতের জীবনে আর ফিরে যাননি। ওয়াটারএইডের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খায়রুল ইসলাম লিখেছেন- ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত ছিল যুগান্তকারী ও বিপ্লবী। শহুরে তরুণদের মধ্যে যখন একটু একটু করে হতাশা আসছে, তখন তিনি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর। শুরুতে তার মাথায় ছিল বাংলাদেশেও বিলাতের মতো জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) প্রতিষ্ঠা করার ভাবনা, যেখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সব নাগরিক সমান মানের স্বাস্থ্যসেবা, এমনকি বিশেষায়িত সেবাও পাবেন। যখন তিনি বুঝলেন, বাংলাদেশে বিদ্যমান জনবল আর সম্পদ দিয়ে সেরকম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন, তখন তিনি তার কৌশল পাল্টালেন; কিন্তু সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলেন না।
মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ হাসপাতালের অভিজ্ঞতায় তিনি গড়ে তুলেছেন প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার নারী কর্মীবাহিনী, যাদের কাজের এলাকা গ্রামে। সেই সত্তরের দশকে নারীদের সাইকেল ও মোটরগাড়ি চালানো এবং নিরাপত্তাকর্মীসহ নানা পেশায় প্রশিক্ষিত করেছেন। পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল, যেখানে চিকিৎসা হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের রেফার্ড করা রোগীদের। মানুষের জন্য চালু করেছেন স্বাস্থ্যবিমা, যে বিমার প্রিমিয়াম নির্ধারিত হয় আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্যই প্রথম প্রতিষ্ঠান, যারা এ দেশে স্বাস্থ্যবিমা চালু করেছে। তার দাঁড় করানো গণস্বাস্থ্যের মডেলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭৫ সালে নিবন্ধ প্রকাশিত হলো বিশ্বের অন্যতম সেরা স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট পত্রিকায়।
১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা-আটা ঘোষণায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার যে চারটি মডেল তুলে ধরা হয়েছিল, গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা ছিল সেগুলোর অন্যতম। সাশ্রয়ী সেবামূল্যের জন্য গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল খ্যাতি পেয়েছে ‘কাজের লোকের’ হাসপাতাল হিসেবে। গ্রামীণ ব্যাংক এবং ব্র্যাকের অংশীদারত্বে এখানেই গড়ে উঠেছে ডায়ালাইসিস করার বিশাল এক ইউনিট। এর সেবামূল্য আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ৩০০ থেকে তিন হাজার টাকা।
এমন সেবামূল্যে দিনে ৩০০ জন কিডনি রোগীকে সেবা দেয়ার সামর্থ্য ও উদাহরণ বিরল। গণবিশ্ববিদ্যালয়, গণস্বাস্থ্য মেডিক্যাল কলেজ- এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এক সেমিস্টার গ্রামে থাকা এবং গ্রামে গিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাৎকার নেয়া বাধ্যতামূলক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কিভাবে তরুণদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে হবে, তা তিনি হাতেকলমে করে দেখিয়েছেন।
‘ধূমপায়ীদের আবেদন করার দরকার নেই’-জাফরুল্লাহ তার প্রতিষ্ঠানে এমন নিয়ম চালু করার ৩০ বছর পর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টির মর্ম অনুধাবন করেছে। ওষুধের দাম সহনীয় রাখলে এবং সহজলভ্য করলে মানুষের পকেটের খরচ কম পড়ে। আশির দশকেই তিনি তা জানতেন বলেই সাশ্রয়ী দামে জেনেরিক নামে ওষুধ বিপণনের জন্য গড়ে তুলেছিলেন গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস।
মুক্তিযুদ্ধ, হাসপাতাল, গণবিশ্ববিদ্যালয়, দেশ গড়া- এসব বাদ দিয়েও বাংলাদেশের ওষুধশিল্প গড়ে ওঠার পেছনে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান স্বীকার করতেই হবে। ১৯৮২ সালে যখন ওষুধনীতি প্রণীত হয়, তখন বাংলাদেশের ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশ ছিল আটটি বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। অপ্রয়োজনীয় ওষুধে বাজার ছিল পরিপূর্ণ। ৮৫ শতাংশ ওষুধই আমদানি করতে হতো। তার ওষুধনীতির কারণে সব অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়; নানা প্রকার নীতি সহায়তা দিয়ে দেশী কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনে উৎসাহিত করা হয়। এ কারণে আশির দশক থেকে বাংলাদেশ ওষুধ নিয়ে স্বস্তিতে আছে।
আজ দেড় শতাধিক দেশে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান ওষুধ রফতানি করে। ওষুধশিল্প আজ প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার, তথা ৩৬ হাজার কোটি টাকার শিল্প! বহুজাতিক কোম্পানির দাপট নেই বললেই চলে। কেউ স্বীকৃতি দিক বা না দিক, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাছে ঋণী।
বাংলাদেশে কোভিডের আক্রমণ সবে শুরু হয়েছে। বিচক্ষণ জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বল্পতম ব্যয়ে ও সময়ে করোনা শনাক্তকরণ পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ নিলেন, একটি শিল্প পরিবারের উদ্যোগে ৩০০ বেডের করোনা চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র চালুতে সংযুক্ত হতে চাইলেন কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে তাতে সম্মতি মেলেনি। পুরো করোনাকালে তিনি স্বল্পব্যয়ে, স্বল্প ওষুধে (৩৩২ টাকায়) করোনা চিকিৎসার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্তিমকালেও তার নিজের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যয় বাহুল্যতা কমিয়ে, বিদেশে যেতে না চেয়ে, যেভাবে তার দেশের কোটি কোটি অধিবাসী সাধারণ চিকিৎসাসেবা লাভ করে মৃত্যুর মিছিলে শামিল হয়ে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেভাবেই চলে গেলেন। কর্মতৎপর জীবন সাধনা, অয়োময় নীতি আদর্শ ও দল মত বা পক্ষাবলম্বনের পরিবর্তে নিরপেক্ষ অবস্থানে লড়াকু মনোভাবের জন্য জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পুণ্য স্মৃতির প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
লেখক : উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৬/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়