শিক্ষিত তরুণরা কেন দেশে থাকার ভরসা পায় না?
ঢাকাঃ ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে,’: বাচ্চাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে পড়ার টেবিলে বসানোর এই মন্ত্র এখন অচল। মাঝে কিছুদিন মন্ত্রটা এমন ছিল - ‘লেখাপড়া করে যে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে সে!’ এখন তাও পুরোনো। শিক্ষিত তরুণদের একটা বড় অংশের স্বপ্ন একটাই- দেশের বাইরে চলে যাওয়া। তাদের লক্ষ্য শুধু উচ্চশিক্ষা নয়। বরং পড়াশোনা শেষ করে ওদেশেই থিতু হয়ে যান তারা, চেষ্টা করেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দ্রুত নাগরিকত্ব পাল্টে ফেলার। এর কারণ কী? কেন দেশে থাকতে চান না তরুণরা? প্রশ্ন করলে অনেকেই এক কথায় বলে দেন ‘উন্নত জীবনের আশা।’
মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ থেকে উচ্চ আয়ের পশ্চিমা কোনো দেশে নিজের ভাগ্য পরীক্ষার আশায় যেতে চান তারা। বিশেষ করে প্রবীণদের সঙ্গে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় বড় একটা ফারাক দেখা যায়। উন্নত দেশে এই ফারাক থাকবে না, জীবনযাপনের মান উন্নত হবে, একটু বেশি স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যাবে, এমন প্রেরণাও অনেকের মাঝে কাজ করে।
বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের চিন্তা একই ধারায় প্রবাহিত হয়। পড়াশোনা শেষ করো। গ্রামে থাকলে শহরে যাও। শহরে থাকলে আরেকটু বড় শহরে যাও। পারলে ঢাকা গিয়ে নিজের চাকরি ভাগ্যের পরীক্ষা করো। কিন্তু ঢাকায়, বা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে জীবন কতটা রঙিন? নেহায়েত হোমরাচোমরা কোনো পদ দখল করে বসতে না পারলে আর দশজনের মতো দৈনিক জ্যাম, বায়ুদূষণ, ভেজাল খাবার, দুর্নীতি আর অনাচারের চক্রে পড়ে যেতে হবে, আর এই চক্রের মাঝেই টুপ করে মরে যেতে হবে একদিন। যারা দেশের বাইরে থিতু হতে চান, তাদের অনেকেরই মাথায় দেশ ছাড়ার চিন্তা আসে এমনই কোনো ধোঁয়া-ধুলোময় সকালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকার ফল হিসেবে।
একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, দেশ ছাড়া মানুষের আশার পেছনে রয়েছে অনেকদিনের হতাশা। আরও বিশদ বলতে গেলে, ক্যারিয়ার সামনে আগাচ্ছে না অথবা কপালে ভালো চাকরি জুটবে না, এমন হতাশার ঠেলায় বিদেশে থেকে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তরুণরা। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সেই সিদ্ধান্তের একটি ধাপ মাত্র।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাই বেশি। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের হার এখন ১২ শতাংশ। অন্যদিকে অশিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্বের হার ১ শতাংশের একটু বেশি। পরিসংখ্যান এটাও বলে, দেশে কারও শিক্ষার ডিগ্রি যত বড়, তার বেকার হওয়ার বা থাকার আশঙ্কাও তত বেশি।
গল্পের ছলে কথা বলতে গেলে দেখি, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরাও মাথায় পাহাড়সমান চাকরির চিন্তা (নাকি দুশ্চিন্তা?) নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছেন।
পড়াশোনার পাট চুকে গেছে, এরপর চার-পাঁচ বছরের শক্তপোক্ত চাকরিজীবন, সব ছেড়ে দিয়ে বিদেশে নতুন করে স্নাতকোত্তর পড়তে যাচ্ছেন, এমন একজনকে প্রশ্ন করেই বসলাম, কেন? উত্তর এলো, ‘ক্যারিয়ার আটকে আছে।’ যে খাতে তিনি চাকরি করছিলেন, একটা সময়ে বুঝতে পারলেন সেখানে ওপরে ওঠার দুটো পথ- এক হলো স্বজনপ্রীতি, অন্যটি হলো দেনদরবার তথা চাটুকারিতা। চাকরির প্রয়োজনে অত নিচে নামতে আত্মসম্মানে বাঁধছিলো, অগত্যা স্টুডেন্ট ভিসাই বেছে নিলেন তিনি।
‘ওখানে গিয়ে মেথরের কাজ করতেও রাজি,’ এমনটা বললেন পরিচিত আরেক তরুণ। সৎ পন্থায় অর্থাৎ মেধার জোরে চাকরি হচ্ছে না, চাকরির পরীক্ষার শেষ পর্যায়ে গিয়ে হেরে যেতে হচ্ছে নিজের চেয়ে কম যোগ্যতার কারও কাছে, বারবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে তার মাঝে জমা হয়েছে ক্ষোভ। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তাকে টপকে যাওয়া ব্যক্তিটির রয়েছে মামা-চাচার জোর। সরকারি এবং বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রেই এহেন অভিজ্ঞতা তার মন বিষিয়ে তুলেছে।
চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের মাঝে এমন অভিজ্ঞতা অহরহই দেখা যায়। চাকরি না করে ব্যবসা করছেন যারা, উদ্যোক্তা হিসেবে সামনে অগ্রসর হতে চাইছেন, অথবা ফ্রিল্যান্সিং করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন, পদে পদে বাধা পেয়ে তাদের মনেও দানা বাঁধছে হতাশা।
এমন পরিস্থিতিতে এই প্রজন্মের তরুণরা নিজের সামনে মোটা দাগে দুটো পথই দেখেন। একটি পথে গেলে দেশে রয়ে যাওয়া যাবে, কিন্তু পদে পদে চাটুকারিতা, স্বজনপ্রীতি দেখতে হবে চোখের সামনে। তাই পাকাপাকিভাবে দেশ ছাড়ার পথটাই অনেকে বেছে নিচ্ছেন।
লেখকঃ কে এন দেয়া
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৭/০২/২০২৪