শিক্ষা নিয়ে গড়ব দেশ তোমার আমার বাংলাদেশ
।। মুহা. আবুযর গিফারী মোল্লা।।
উন্নত শিক্ষার মাধ্যমে উন্নত দেশ ও জাতি গঠন করা যায়। দেশ ও জাতির উন্নতিতে দেশের শিক্ষার উন্নতিতে পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, দেশের শিক্ষানুরাগী, বিদ্যোৎসাহী, শিক্ষিত সমাজ এবং শিক্ষক সমাজ ভুমিকা পালন করেন। সার্বিকভাবে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও স্বাধীন বিচার বিভাগের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা পালন ছাত্র সমাজের উপর নেতিবাচক ছাপ ফেলেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এখন আঘাত করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থা এর বাইরে থাকবে এটা হতে পারে না।
শিক্ষাস্তরের সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের নৈতিক পদস্খলন ঘটেছে। শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপেশাদার মনোভাব ও বিশৃঙ্খল অবস্থার সংস্কার ছাড়া কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ব্যাপারে সচেতন, যারা নিজেদের দেশপ্রেমিক দাবি করেন সেসব শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে সহায়ক হবে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জানতে পারছি দেশে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক দৃঢ়তা কমেছে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আবাসিক হলে স্বামীকে আটকে রেখে সংঘবদ্ধভবে এক নারীর সম্ভ্রমহানী ঘটিয়েছে।
এর আগে সিলেটে এমসি কলেজের কিছু শিক্ষার্থী স্বামীকে আটকে রেখে সংঘবদ্ধভাবে এক নারীর সম্ভ্রমহানী ঘটিয়েছে। বুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী গেস্টরুমে পিটিয়ে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু শিক্ষার্থী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে খিচুড়ী ভাগাভাগি করাকে কেন্দ্র করে দিন-দুপুরে পিটিয়ে আহত করে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী নাসরুল্লাহ নাছিমকে।
পৈশ্বাচিক নির্যাতনের পরে তারা আবাসিক হলের তিন তলার বেলকোনি থেকে ফেলে হত্যা করেছে নাসরুল্লাহ নাছিমকে। ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীদের দেহ ব্যবসায় বাধ্য করেছে সেই কলেজের শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারীর বস্ত্রহরণের ঘটান ঘটেছে কয়েকবার।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বাকিতে খারার খেয়ে আর পরিশোধ করেনি। এ কারণে শিক্ষার্থীদের প্রিয় বাবুর হোটেল বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ঢাকা নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির তিন জন বালিকা বিটিএস সদস্যদের বিয়ে করতে ঘর ছেড়েছে।
কেন এত অধপতন হয়েছে শিক্ষার্থীদের? একদিনে এমন খাদের কিনারে এসে দাঁড়ায়নি শিক্ষার্থীরা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শাসন করতে পারেন না শিক্ষক। আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উ”চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা ক্লাস ফাঁকি দেয়। ডিভাইস নিয়ে ক্লাসে আসে।
অসম্পূর্ণ ইউনিফর্ম পরিধান করে। প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্মে পার্কে, বনে জঙ্গলে, খালের নৌকায় দোসর খুজছে তারা। কিশোর গ্যাং তৈরী করেছে শিক্ষার্থীরা। নেশায় আসক্ত হচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। ইভ টিজিং এর মতো অপরাধ কোনো অপরাধই না তাদের কাছে। কোনটা অপরাধ এ বিষয়ে সঠিকভাবে জ্ঞানও রাখেনা শিক্ষার্থীরা।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাসেই উপস্থিত থাকে না, শুধু পরীক্ষায় উপস্থিত হয়। এসব আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আইন এবং দেশের দন্ডবিধি উভয় আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
তার পরেও শিক্ষার্থীরা অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে
কীভাবে? কারণ শিক্ষার্থীরা জেনে গিয়েছে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের কাজ ঠিকভাবে করে না। প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত। বিশ্বজিৎ দাস রাস্তায় প্রাণ দেয়। সাংবদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয় না। গুলশানে মুনিয়া হত্যা কাÐকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। পুলিশ প্রটেকশনে শরিফুজ্জামান নোমানীকে হত্যা করা যায়। ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খাদিজাতুল কোবরাকে বিনা বিচারে কারাগারে আটক রাখা যায়। ব্যারের এনকাউন্টারে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী লিমন পা হারায়। স্কুল শিক্ষার্থী ত্বকী হত্যা কান্ডের চার্জশিট আট বছরেও প্রাপ্ত হয় না।
জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত জামালপুরের ডিসি নারী সহকর্মীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়লেও সমস্যা হয়না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটরের সাথে বিবাহবর্হিভূত শারীরিক সম্পর্ক রাখতে পারেন। ক্যাবিনেট সদস্য চিত্রনায়িকাকে রেপ করার জন্য হোটেল শেরাটনে ডাকতে পারেন। মতিঝিল থানার পাশেই নিষিদ্ধ জুয়াখেলা ক্যাসিনো চলতে পারে। নেশাকরার জন্য বোটক্লাবে যাওয়া যায়। এ কারণে শিক্ষার্থীরা একটু আচরণবিধি লঙ্ঘন করে।
বিচার বিভাগ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে অপরাধীরা অপরাধ করতে সাহস পায় না। কিন্তু শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপের কারণে একজন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা পদত্যাগ করেছেন। তিনি দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। বিচার বিভাগ হতশ্রী অবস্থায় নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে কীভাবে?
শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা মাপা হয় পরীক্ষার মাধ্যমে। শিক্ষা প্রশাসনের সাথে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা যখন থেকে জেনেছে পরীক্ষার আগে প্রশ্ন পাওয়া যাবে তখন থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে তারা। শুধু ডিজিটাল ডিভাইস স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে। কখন যেনো প্রশ্ন হাতে পাওয়া যাবে! কোন রকম পর্যালোচনা ছাড়া বিরোধিতা সত্তে¡ও শিক্ষাপ্রশাসন সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করেছিলো।
মাত্র এক দশকে সৃজনশীল পদ্ধতির অসারতা প্রমাণ হলে তা উঠিয়ে নেয় কর্তৃপক্ষ। এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয়েছে। আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু করেছে শিক্ষাপ্রশাসন। এতেও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বোদ্ধাদের আপত্তি রয়েছে। এই ধরণের খামখেয়ালিপনার জন্য শিক্ষার্থীদের এবং সমৃদ্ধ জাতি গঠনের প্রচেষ্টায় যে ক্ষতি হয়েছে তা অবর্ণনীয়।
শিক্ষকরা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নন। তাঁরা বিচার বিভাগেরও সদস্য নন। তাই বলে দেশ রক্ষায় শিক্ষকদের দায়িত্ব থাকবেনা এমনও না। শিক্ষকদের কাছে শিক্ষা লাভ করেই পেশাজীবন শুরু করেন পেশাজীবীরা। একারণে শিক্ষকরা বাড়তি দায়িত্ব গ্রহন করেন। শৈশব থেকে শিক্ষাজীবনে নীতি নৈতিকতার মজবুত প্রশিক্ষণ শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে কর্মজীবনে সুপথ দেখায়।
শিক্ষার্থীরা নীতি নৈতিকতার পথ হারায়না। দেশে এমন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষানুরাগী, বিদ্যোৎসাহী, শিক্ষক আছেন যারা দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে থাকতে পারেননা। যারা সচেতন, যারা নিজেদের দেশপ্রেমিক দাবি করেন সেসব শিক্ষক আগামী প্রজন্ম বিনির্মানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উন্নত দেশ ও জাতি গঠনে প্রকৃত রুপকার শিক্ষকগণ।
শিক্ষকদের প্রচন্ড ক্ষমতা আছে। আর সেই ক্ষমতা হলো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শিক্ষকের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর শুভাকাক্সক্ষী, পক্ষপাত করেননা, সত্যবাদি, নৈতিক, অন্যায় সহ্য করেননা, সময়ানুবর্তী, দায়িত্ব পালনে আন্তরিক এমন হলে সেই শিক্ষককে শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষক শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধার পাত্র হলে সেই শিক্ষকের প্রতিটি পরামর্শ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীকে সুপথে পরিচালনা করা যায়। এখানেই শিক্ষকের সার্থকতা।
তার পরেও কিছু শিক্ষার্থী আছে যাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষকগণ একাডেমিক আইন প্রয়োগ করেন। কলেজিয়েট হলেই কেবল পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করতে পারবে শিক্ষার্থী। নন কলেজিয়েট হলে অবশ্যয় জরিমানা নিতে হবে। ডিসকলেজিয়েট হলে কোনো ভাবেই পরীক্ষা দিতে পারবে না। শুধু এই আইন কঠোরভাবে অনুসরণ করলেই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হবে। তাহলে শিক্ষার্থীরা দিনের একটা বড় সময় একাডেমিক কাজে ব্যস্ত থাকলো।
আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গকারী কাজ থেকে বিতর রাখা গেলো শিক্ষর্থীকে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। পরীক্ষার হলে কোনো শিক্ষার্থীর উপর অবিচার না করা। তবে কোন শিক্ষার্থী অসদুপায় অবলম্বন করলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যয় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এতে শিক্ষার্থী ভালো অধ্যয়ন করার জন্য সারা বছর ব্যস্ত থাকবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বাড়ির কাজ সম্পন্ন না করে ক্লাসে আসলে তাদের পড়া বিদ্যালয়ে প্রপ্ত করে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন শক্তিশালী হবে। আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে ব্যস্ত রাখতে পারলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিরাপদ রাখা যাবে। এভাবে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষকরা যে দেশ গড়বে তা হলো আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব
[ মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব । এর জন্য পত্রিকা কতৃপক্ষ দায়ী নয়]
শিবা/জামান, ১৫.০২.২০২৪