শিক্ষার্থীদের শিখন প্রকল্পের টাকা লুটপাট
টাঙ্গাইলঃ পাঠদানের জন্য নিয়োজিত আছেন ৭০ শিক্ষক। উপানুষ্ঠানিকের ৭০ শিখন কেন্দ্র দেখভালে রয়েছেন পাঁচজন সুপারভাইজার। ঝরে পড়া ৩০ শিশু শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছেন এক শিক্ষক। সব আয়োজনই ঠিকঠাক, তবে শুধুই কাগজ-কলমে। বাস্তবে শিখন কেন্দ্রে ঝরে পড়া কোনো শিক্ষার্থীই নেই। পাঠদানের কেনো কার্যক্রমও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবু রয়েছে ২ হাজার ১০০ শিশু শিক্ষার্থীর তালিকা। তালিকায় থাকা শিশুরা পাশের মাদ্রাসা, কিন্ডারগার্টেন ও সরকারি প্রাথমিকের নিয়মিত শিক্ষার্থী। ‘শিখন’ কেন্দ্রগুলোতে শুধু সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
কোনোটিতে সাইনবোর্ডও নেই। সখীপুর উপজেলার ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার জন্য সরকারের ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ কর্মসূচি বাস্তবায়নে ‘সহায়ক’ ও ‘সহযোগী’ সংস্থার কার্যক্রমের চিত্র এটি।
সহায়ক ‘উদয়’ ও সহযোগী ‘পসশিক’ নামে দুটি সংস্থার মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর আওতায় ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ প্রকল্পের শিখন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর তথ্যমতে, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার আওতায় আনতে ‘আউট অব স্কুল চিলড্রেন এডুকেশন’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সখীপুর উপজেলার ২ হাজার ১০০ ঝরে পড়া শিশুর শিক্ষার জন্য ৭০টি উপানুষ্ঠানিক শিখন কেন্দ্র উদ্বোধন করা হয়। প্রত্যেক শিক্ষক মাসে ৫ হাজার, সুপারভাইজার ১৫ হাজার ও কেন্দ্রের ঘর ভাড়ার জন্য দেড় হাজার টাকা বরাদ্দ আছে। ঝরে পড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে বই, খাতা-কলম, ড্রেস, স্কুলব্যাগ ও মাসিক ১২০ টাকা করে উপবৃত্তি দেওয়ার কথা, যা প্রকল্পের শর্ত।
শুরুর ছয় মাস প্রকল্পের কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল। এর পর থেকে শুরু হয় ঝরে পড়া শিশুদের সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধানে অনাগ্রহ। শিক্ষকরা নিয়মিত বেতন পান না। ছয় মাসের মধ্যে দু-তিন মাসের বেতন পেলেও কমিশন দিতে হয় বাস্তবায়ন ‘কর্তা’ ব্যক্তিদের। নিয়মিত নেই ঘর ভাড়া। মাঝে মধ্যে কিছু পেলেও গুনতে হয় কমিশন। শিশুরা পাচ্ছে না বই, খাতা-কলম, ড্রেস, স্কুলব্যাগসহ কোনো শিক্ষা উপকরণ। গত ছয় মাস সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রকল্পের এমন দৈন্যদশার চিত্র জানা গেছে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘সরকারের টাকা লুটপাট ছাড়া কিছুই হচ্ছে না এ প্রকল্পে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনই ছিল এ প্রকল্পের মূল কার্যক্রম।’ স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট ও বাস্তবায়ন সংস্থা মিলেমিশেই এ লুটপাটের অংশীদার।
একাধিক জনপ্রতিনিধি জানান, ঝরে পড়া শিশুদের শিক্ষার নামে কেন্দ্র ও তালিকা উপস্থাপন করে শুধু প্রকল্পের টাকা লুটে খাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা।
কথা হয় মওলানাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। সমকালকে তিনি বলেন, ‘শুরুর প্রথম ৬ মাস পাঠদান মোটামুটি চলছিল। পাশের শিখন কেন্দ্রটিতে ঝরে পড়া কোনো শিক্ষার্থী নেই। আমাদের বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।’
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রকল্পের একাধিক শিক্ষক জানান, গত ৬-৭ মাসে প্রত্যেক শিক্ষককে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০ হাজার টাকা। এ টাকা থেকে আবার কমিশনও দিতে হয়েছে বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের। ঘর ভাড়ার টাকাও দেওয়া হয় নামকাওয়াস্তে। সেখানেও খরচের অজুহাতে নেওয়া হয় কমিশন।
প্রকল্পের সুপারভাইজার মুনছের আহমেদের ভাষ্য, গত জুলাই থেকে বই না পাওয়ায় কার্যক্রম একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পেলেই কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করা হবে।
কথা হয় ‘পসশিক’-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। সমকালকে তিনি বলেন, ‘এখনও অর্থ না পাওয়ায় শিক্ষক-সুপারভাইজারদের বেতন, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা উপকরণ, উপবৃত্তি দিতে না পারায় কার্যক্রম একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। আশা করছি, এ মাসেই সমাধান হবে।’
সখীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারীর ভাষ্য, খোঁজখবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে শিগগিরই উপজেলা মনিটরিং কমিটিকে সভা করার নির্দেশনা দেওয়া হবে।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৪/০৩/২০২৪