শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে ভোগান্তি
নিউজ ডেস্ক।।
জাতীয় পরিচয়পত্রের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে জন্মনিবন্ধন সনদ। পাসপোর্ট তৈরি, বিয়ে ও জমি রেজিস্ট্রেশন, শিশুদের করোনার টিকা এবং স্কুলে ভর্তিসহ ১৭টি সেবার ক্ষেত্রে জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জন্মনিবন্ধন সনদের গুরুত্ব আগে থাকলেও এবার তা আরও বেড়েছে। নিবন্ধন সনদের কদর বাড়লেও এই সংক্রান্ত সেবার মান বাড়েনি। ডিজিটাল সনদ প্রদানে সক্ষমতা না বাড়িয়ে সেটির গুরুত্ব বাড়ানো ভোগান্তিতে পড়েছে জনগণ।
পাসপোর্ট তৈরিতে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিকল্প হিসেবে, বিয়ে নিবন্ধন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার তালিকা তৈরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, ব্যাংক হিসাব খোলা, আমদানি ও রফতানি লাইসেন্স, গ্যাস, পানি, টেলিফোন এবং বিদ্যুত সংযোগের অনুমতি, করদাতা শনাক্তকরণের নম্বর, ঠিকাদারি বা চুক্তির লাইসেন্স, ভবন নক্সার অনুমোদন, ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি এবং মোটরযানের নিবন্ধন পেতে জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আগামীতে এই সনদের মাধ্যমে সেবা গ্রহণের পরিধি আরও বাড়বে। দেশের সব বয়সী মানুষের তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষণের উদ্যোগের অংশ হিসেবে নিবন্ধন সনদের গুরুত্ব বাড়ানো হচ্ছে।
বর্তমানে স্কুল-কলেজের টিকার নিবন্ধনে শিশু-কিশোরদের জন্মনিবন্ধনের ডিজিটাল সনদের বাধ্যবাধকতা জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। কাজ সহজীকরণের জন্য নিবন্ধনের ডিজিটাল সনদ ব্যবহৃত হলেও এখন তা উল্টো মানুষকে চাপে রেখেছে। চাপ এতটাই যে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে জরুরী ভিত্তিতে এই সনদ সংগ্রহকারীকে। সংশ্লিষ্ট সেবার সঙ্গে জড়িত সংস্থার জনবল সঙ্কট, দক্ষতার অভাব এবং ইন্টারনেটের ধীরগতিতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ এতটাই যে, তারা বলছেন এই ডিজিটাল আমি চাই না, যেটি করতে গিয়ে কাজ কর্ম বাদ দিয়ে সারাদিন সেটির পিছনে ছুটে মরতে হয়।
পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া থানার অষ্টমনিষা গ্রামের শতরুপা পাল মামার বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করেন। মামার পাশের বাড়ির স্কুলের ৯ম শ্রেণীতে পড়া শতরুপার টিকার নিবন্ধন ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ ছাড়া হচ্ছিল না। অনেক কষ্ট করে অষ্টমনিষার ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তার আত্মীয় স্বজন সনদ সংগ্রহ করলেও তার সনদে ভুল থাকায় তা দিয়ে নিবন্ধন হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পরবর্তীতে ভোগান্তির পর ডিজিটাল সনদ সংগ্রহ করতে হয়েছে। আর সেটি নিতে গিয়ে তার মা-বাবার সনদও জোগাড় করতে হয়েছে। একটি সনদের জন্য বাড়ির আরও সদস্যের নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করতে হয়েছে।
শাঁখারীবাজারে বাসিন্দা আব্দুর সবুরের মেয়ে পড়েন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণীতে। তার মেয়ের টিকার নিবন্ধনে দরকার পড়ে ডিজিটাল সনদের। রাজধানীতে ভাড়াটিয়া হিসেবে থাকায় তিনি তা সংগ্রহ করতে যান গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে। সেখানকার পৌরসভাতে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্য নিবন্ধনের আবেদন করেন। আবেদন করার পর পৌর কর্মকর্তারা তখন জানান, সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন অবশ্যই থাকতে হবে। তার স্ত্রীর নিবন্ধন সনদ থাকলেও সবুরের ছিল না। এরপর তিনি পৌরসভায় নিজের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন। নির্ধারিত ফি দিয়েও তিনি যথা সময়ে জন্মনিবন্ধন পাননি। তার নিবন্ধন না পাওয়ায় ছেলেমেয়ের সনদও নিতে পারেননি। সবুরের মতো পুরো দেশেই সাধারণ মানুষ জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। এভাবেই নিবন্ধন সনদের ভোগান্তি ব্যাহত করতে টিকাদান কর্মসূচীকে।
রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরের ভুক্তভোগীরা বলছেন, কারও জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য আবেদন করার শর্তে জটিলতা রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে সনদ প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা। কোন কোন জায়গায় কর্মচারীরা সরকারী ফির বাইরেও অর্থ নিচ্ছেন কাজটি দ্রুত করে দেয়ার কথা বলে। জরুরী প্রয়োজন মেটাতে জনগণ বাড়তি অর্থ প্রদান করছে বিনা বাক্য ব্যয়ে।
অভিযোগে জানা গেছে, জনবল সঙ্কট, দক্ষতার অভাব, অসৎ চক্র, ভুল টেকনোলজির ব্যবহার, ইন্টারনেটের ধীরগতি, কেন্দ্র্রীয় সার্ভারে ত্রুটি, সেবাদানকারীর দুর্ব্যবহার, তথ্য প্রদানে অনীহা এবং নাগরিকদের সচেতনতার অভাবে সারাদেশের ‘জন্মনিবন্ধন সনদ’ কার্যক্রম কঠিন হয়ে পড়ছে।
জনগণের জরুরী ভিত্তিতে নিবন্ধন সনদের প্রয়োজন মেটাতে আপাতত সরকারের পক্ষ থেকেও দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেই। তবে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম সহজ এবং সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে বিভাগীয়, সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এবং ইউনিয়ন জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। তাদের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনে সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এসব টাস্কফোর্স ঠিকমতো কাজ করছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছুদিন আগেও জন্মনিবন্ধনের ডিজিটাল সনদের চাহিদা এতটা ছিল না। তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি। এখন শিশু-কিশোরদের টিকাদানসহ বিভিন্ন কাজে সনদের গুরুত্ব থাকায় সবাই চাপ দিচ্ছে নিবন্ধন পেতে। অতিরিক্ত মানুষের চাপেই কাজে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। আগামীতে লোকবল বাড়লে এই কাজে গতি আসবে।
জন্মনিবন্ধনের ডিজিটাল সনদ সংগ্রহে ভোগান্তি এবং তার সমাধান বিষয়ে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জেনারেল (অতিরিক্ত সচিব) মুস্তাকীম বিলাহ ফারুকী বলেন, জন্মনিবন্ধন বিষয়ে দেশের সব জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। জনগণকে জন্মনিবন্ধনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তাদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধনে প্রকৃতপক্ষে কোন ভোগান্তি নেই। তবে কিছু কিছু অসুবিধা আছে। সরকার অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের দিকে এগোচ্ছে।
জন্মনিবন্ধন সংশোধনে ভোগান্তির বিষয়ে তিনি জানান, সনদ সংশোধনে প্রকৃতপক্ষে কোন ভোগান্তিই নেই। অনলাইনে ঘরে বসে সহজেই সংশোধন করা যায়। তিনি আরও বলেন, মানুষ জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে এতদিন সচেতন ছিল না। এখন সচেতন হচ্ছে। কারণ ১৭টি সেবা পেতে বাধ্যতামূলকভাবে জন্মসনদ লাগে। রেজিস্ট্রার জেনারেল আরও বলেন, এই খাতে টেকনিক্যাল কাজের লোক মাত্র দুজন। তাদের মধ্যে একজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছেন। এজন্য টেকিনিক্যাল সাপোর্ট তুলনামূলকভাবে কম। আমরা জনবল বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি।
শিশু-কিশোরদের ডিজিটাল সনদ জটিলতায় বাংলাদেশে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেয়ার যে কর্মসূচী শুরু হয়েছে তা জন্মনিবন্ধন সনদের জটিলতায় অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের সুরক্ষা এ্যাপের মাধ্যমে শিশুদের জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে নিবন্ধন করার নিয়ম। কিন্তু ডিজিটাল জন্মনিবন্ধন সনদ না থাকার ফলে সুরক্ষা এ্যাপ সেটা গ্রহণ করছে না। এ বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি অধিদফতরের মহাপরিচালক রেজাউল মাকছুদ জাহেদি বলেন, যাদের জন্মনিবন্ধন ১৭ ডিজিটের তারাই পারছেন নিবন্ধন করতে। তিনি বলেন, সুরক্ষা এ্যাপে ১৭ ডিজিট লিমিট দেয়া আছে। এখন যাদের অফলাইনে জন্মনিবন্ধন করা আছে আগে, তারা স্থানীয় সরকার বিভাগে আবেদন করলে তারা ১৭ ডিজিট করে দেবেন। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য আসলে আমরা সেটা নতুন করে এ্যাপে সংরক্ষণ করে নেব।