শিক্ষক কেন মার খাবেন!
।। মো. খশরু আহসান।।
এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি, তখনও এ দেশের কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো শিক্ষক মার খাচ্ছেন অথবা মারমুখী আচরণের শিকার হচ্ছেন– এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়! সর্বশেষ গাজীপুরের ঘটনায় নতুন করে জাতির বিবেক আঘাতপ্রাপ্ত হলো।
ছোট ভাই এবং দুই ভাতিজার বিরুদ্ধে একজন প্রভাষককে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ এসেছে। [সমকাল, ২৯.০১.২৪] বিগত কয়েক বছরে শিক্ষকরা যে পরিমাণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার হিসাব কষতে গেলে চোখ কপালে উঠবে। সংখ্যাটা কমার পরিবর্তে বর্তমান সময়ে বরং মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে চলেছে। কারণ এমন ঘটনাগুলোর বিপরীতে তেমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই।
যেদিন থেকে সমাজে শিক্ষক নির্যাতন শুরু হয়েছে, সেদিন থেকেই সামাজিক বিবেকবোধে পচন ধরেছে। সমাজ থেকে বিনয় মুছে যেতে শুরু করেছে। সেই স্থানে জায়গা করে নিয়েছে দাম্ভিকতা! পুঁজিবাদি সমাজে মানুষ স্বভাবতই তাদের ক্ষমতা এবং আধিপত্যকে জাহির করতে চায়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভালো শিক্ষা বলতে সমাজে অবশিষ্ট যা কিছু আছে তাও লজ্জাবতী ফুলের লুকিয়ে থাকার মতো! পুঁথিগত বিদ্যা যদি শুধু শিক্ষা হতো, তাহলে সুশিক্ষা আর কুশিক্ষা বলে কিছু থাকত না।
গ্রাম থেকে শুরু করে শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বাড়ছে। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় চিহ্নগুলোর একটি ‘চাইল্ড কেয়ার’, ‘ডে কেয়ার’ এবং ওল্ড কেয়ারের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা বাড়ছে। শুধু মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নগামী রেখা দিনে দিনে আরও বেশি নিম্নমুখী হচ্ছে।
নির্যাতনের ফলে শিক্ষকের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের কতটুকু ভাবায় বলতে পারি না। নির্যাতনে যাদের মৃত্যু হয়নি তাদের পরিস্থিতি আরও বেশি শোচনীয়। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও বটে। একটু গভীরভাবে ভাবলে গা শিউরে ওঠার কথা! অপমানের শিকার হওয়া শিক্ষক প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে, নিজের কাছে নিজে অপমানিত হন। ছোটবেলায় বাংলা বিষয়ে প্রায়ই ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ নিয়ে রচনা লেখার চল ছিল। এখনও আছে। সেই রচনা লেখা কি তবে শুধুই পরীক্ষায় নম্বর তুলতে লেখার জন্য লেখা?
২০২২ সালের দিকে নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরানো হয়েছিল। একজন শিক্ষকের এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া আর মৃত্যু হওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অর্থাৎ দেশের অসংখ্য শিক্ষক আত্মিক মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে বেঁচে আছেন না থাকার মতো করে। নির্যাতনকারীরা শিক্ষকের গায়ে হাত দেওয়া অব্দিই থেমে থাকে না। সেই শিক্ষককে নিয়মিত হুমকি-ধমকির মধ্যেও রাখে।
মানুষ দেশের রাজনৈতিক সুরক্ষা নিয়ে কথা বলে, অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিয়ে টকশোগুলোতে আলোচনার ঝড় বয়, কূটনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের সরব অবস্থান। আরও অনেক বিষয়ে সুরক্ষার কথা হয়। শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনের রেশ জাগে। শুধু শিক্ষকরা পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে পারেন না। তাদের বিবেক বাধা দেয়। কারণ তারাই জাতির বিবেক।
সুরক্ষার জন্য মানুষ তাদের কণ্ঠকে উজ্জীবিত করবে সেটিই স্বাভাবিক। তবে শিক্ষক সম্প্রদায়ের সুরক্ষার জন্য কোনো আলাপচারিতা আমি অন্তত তেমন দেখি না। শিক্ষক মার খাচ্ছেন অথচ কোনো প্রতিবাদ নেই, আলোচনা নেই, টকশোতে সমালোচনাও নেই।
রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার আদায়ে তারা সমাবেশ করে, হরতাল পালন করে, অবরোধের ডাক দেয়। অথচ জাতির বিবেক আঘাতপ্রাপ্ত হলে তাদের পক্ষে কাউকে জোর গলায় আওয়াজ তুলতে দেখি না। শিক্ষকরা নীরবে ব্যথা পান, অথচ প্রকাশ করেন না। নিভৃতে কাঁদেন, হাসিমুখে মেনে নেন।
আশা করেন আর কখনও এমন হবে না! অথচ হয়, হতেই থাকে! ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গার একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে। অসদুপায় অবলম্বন করার ফলে শিক্ষক শিক্ষার্থীর খাতা নিয়ে টেবিলে এনে রাখেন। সেই শিক্ষার্থী পরে শিক্ষককে সবার সামনে চড় মারেন। এই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অহরহ ঘুরে বেড়িয়েছে। শিক্ষক মার খাচ্ছেন! আমরা তা দেখছি। কী ভয়াবহ দৃশ্য!
সরকার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করেছে ঠিকই, তবে শতভাগ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারেনি। আমাদের দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের আচার-আচরণ ভালো হওয়ার বদলে হচ্ছে খারাপ, আগ্রাসী। শিক্ষকরা বাবা-মায়ের মতোই শিক্ষার্থীকে আগলে রাখেন। অথচ সেই শিক্ষকরাই সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীর হাতে লাঞ্ছিত হন।
ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীরা শিখতে পারছে না নাকি শিক্ষকরাই তাদের শেখাতে পারছেন না– তা বলা মুশকিল। আজকাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই কিছুটা রগচটা মেজাজের হতে শুরু করেছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কতিপয় শিক্ষার্থীর অদৃশ্য পাখা গজাচ্ছে। যেভাবেই হোক, তারা হয়ে যাচ্ছে গ্যাংলিডার। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের গায়ে আঘাত করছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এর পেছনে শক্তিশালী রাজনৈতিক মদত থাকে।
বাংলাদেশে ক্যাম্পাসগুলোতে লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বেড়ে গিয়ে ঠেকেছে অপরিপক্ব ছেলেমেয়েদের হাতে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের অপরিপক্বই বলা যায়। বিবেক বুদ্ধির পরিবর্তে এই সময়টায় প্রাকৃতিকভাবেই শিক্ষার্থীরা আবেগকে বেশি প্রাধান্য দেয়।
এই যে যেসব শিক্ষার্থী শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার মতো মানসিকতাকে ধারণ করে; সেসব শিক্ষার্থীর কাছে ওই মুহূর্তে ভালো কিছু আশা করা যায় বলে আমার মনে হয় না। অধিকাংশই হয় কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়ে, না হয় ধনী বাবার সামাজিক গরমে। যে কারণেই হোক না কেন, তা ক্ষমার অযোগ্য। সংবাদ অথবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে খবরগুলো দেখা যায়, তার বাইরেও কোনো শিক্ষক নির্যাতনের শিকার হন না; তার নিশ্চয়তা কী!
একুশ শতকের এই সময়ে মানুষ জাতিগতভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে, কূটনৈতিকভাবে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করছে। অথচ অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমাকে তখন লিখতে হচ্ছে দেশের শিক্ষকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা!
লেখক : নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী