শিক্ষক ও শিক্ষকতা পেশা
মো. মোজাহিদুল ইসলামঃ একজন সফল মানুষের পেছনে শিক্ষকের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। শিক্ষক শুধু সফল নয়, একজন ভালো মানুষ হতে শেখান। একটি সমাজে তথা দেশে শিক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক বিপর্যয় বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষকরা অবিরাম ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
শিক্ষক হচ্ছেন সভ্যতার ধারক-বাহক। শিক্ষক শুধু শিক্ষাদানই করেন না, তিনি মানুষ গড়ার কারিগরও। আমাদের সমাজে শিক্ষকতা পেশাকে মহান, আদর্শ, সম্মানিত ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করা হয়ে থাকে। সমাজের চোখে শিক্ষকরাই হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। ব্যক্তিজীবনে তারা ন্যায় ও নীতির চর্চা করবেন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য উন্নত চিন্তা আর জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন, সমাজ এমনটাই আশা করে। যারা এই মাপকাঠিতে পড়বেন না, তাদের যে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করা উচিত নয়, সমাজ তাদের তা বারবার স্মরণ করিয়েও দেয়। শিক্ষকতা এখনো আমাদের সমাজে একটি সম্মানিত পেশা।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনের সর্বপ্রথম বাণী ‘পড়! তোমার রবের নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ শিক্ষার গুরুত্ব যে কত অপরিসীম তা মহান আল্লাহ ঐশী গ্রন্থের মাধ্যমে মানব জাতিকে অবহিত করেছেন বহুকাল পূর্বে। প্রিয়নবী (সা.) বলেছেন- ‘আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে শিক্ষক হিসেবে।’ এখানে শিক্ষা ও শিক্ষক শব্দদ্বয় একটি অপরটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে শিক্ষক বা ওস্তাদের প্রয়োজন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) আর তাঁর শিক্ষক ছিলেন সৃষ্টি জগৎসমূহের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালা। আর রাসূল (সা.) হচ্ছেন মানব জাতির সর্বোত্তম শিক্ষক। শিক্ষাই আলো, শিক্ষা ছাড়া সকল পথ বা মত অন্ধকার। নৈতিক শিক্ষাই জাতির একমাত্র পাথেয়। নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। এজন্যই প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে প্রকৃত খোদাভীরু, আদর্শ ও নৈতিকতাধারী শিক্ষকের বিকল্প নেই।
সাম্প্রতিককালে শিক্ষকদের বাস্তবিক অবস্থানের যে পরিবর্তন হয়েছে তা অকল্পনীয়, অভাবনীয়। একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও মানবসম্পদের উন্নয়ন ঘটে- এই প্রতিপাদ্যকে মাথায় রেখে দেশে মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করতে গত দশ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বর্তমান সরকার। শিক্ষার প্রসার ও জনগণকে শতভাগ শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। তারপরও বলতে হয় শিক্ষকতা পেশায় সুযোগ-সুবিধা এখনো আশাব্যঞ্জক নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রয়েছে অসম বৈষম্য।
আমাদের সমাজে শিক্ষকদের আর্থিক সচ্ছলতা কম থাকার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষকই প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হন। এসব শিক্ষক মন থেকে ভালোবেসে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেছেন। তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু জীবন চালানোর জন্য তো জীবিকার দরকার!
আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষকেরা সামাজিক ও আর্থিকভাবে আরও বেশি বঞ্চিত। বেতনের জন্য কিংবা নিজেদের মর্যাদা আদায়ের জন্য শিক্ষকদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়। পেশা হিসেবে শিক্ষকতা এখন হতাশাজনক অবস্থায়। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক অবস্থায় আনতে হবে। নতুবা শিক্ষার গুণগত মান বজায় না থাকলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। মাদার অব হিউম্যানিটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে উন্নয়নের মহাসাগরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী চালিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্ত পরিশ্রম। আর একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই পারে প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করতে। তাই শিক্ষকদের সামাজিক, পেশাগত ও আর্থিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে। পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।
উন্নত বিশ্বে শিক্ষকতা পেশাকে শ্রেষ্ঠ পেশা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। কারণ এ পেশার সঙ্গে আদর্শ, সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশি মাত্রায় জড়িত। একজন শিক্ষকের আদর্শ ও মানবিক মূল্যবোধ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দিলেও তার চিন্তা-চেতনা ও মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। কারণ সন্তানের কাছে পিতা-মাতার আদর্শ যেমন অনুকরণীয় তেমন একজন শিক্ষকের আদর্শও একজন শিক্ষার্থীর কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সমাজে পিতৃতুল্য কিংবা জীবনে চলার পথে আদর্শ ও অনুকরণীয় হতে পারেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা সামান্য।
একজন শিক্ষকের যোগ্যতার অভাবে শিক্ষাদানের কার্যটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। বলা হয়: ‘গায়ের জোরে আর যাই হওয়া যাক না কেন, গুরু হওয়া যায় না।’ তাই শিক্ষাকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযোগ্য ও আদর্শবান সুশিক্ষক।
একজন শিক্ষকের নিম্নলিখিত যোগ্যতাগুলো অবশ্যই থাকা উচিত-
শিক্ষক যোগ্যতার মূল ক্ষেত্র তিনটি। যথা:
১. পেশাগত জ্ঞান ও উপলব্ধি।
২. পেশাগত অনুশীলন এবং
৩. পেশাগত মূল্যবোধ ও সম্পর্ক স্থাপন।
শিক্ষক যোগ্যতার তিনটি মূল ক্ষেত্রের বিপরীতে ১৫টি উপক্ষেত্র নিম্নরূপ:
পেশাগত জ্ঞান ও উপলব্ধির ৫টি উপক্ষেত্র-
(ক) বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান।
(খ) শিক্ষাদান সম্পর্কিত জ্ঞান।
(গ) শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ধারণা।
(ঘ) ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্কে ধারণা এবং
(ঙ) আইন-কানুন সম্পর্কিত ধারণা।
পেশাগত অনুশীলনের ৬টি উপক্ষেত্র-
(ক) পরিকল্পনা প্রণয়ন সম্পর্কিত।
(খ) প্রত্যাশা।
(গ) যোগাযোগ দক্ষতা।
(ঘ) শ্রেণিকক্ষের ব্যবস্থাপনা
(ঙ) উপকরণের ব্যবহার এবং
(চ) মূল্যায়ন।
পেশাগত মূল্যবোধ ও সম্পর্ক স্থাপনের ৪টি উপক্ষেত্র-
(ক) সমতার প্রতি অঙ্গীকার।
(খ) চিন্তন অনুশীলন এবং পেশাগত উন্নয়ন।
(গ) স্থানীয় জনগণের সাথে কাজ এবং
(ঘ) সহকর্মীদের সাথে কাজ।
একজন ভালো শিক্ষক পাঠ্যপুস্তক ছাড়াই পাঠের বিষয়বস্তু উপস্থাপন করবেন, উন্মুক্ত প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলী করে তুলবেন, বিষয়বস্তু অনুধাবনে জীবনঘনিষ্ঠ উদাহরণ দিবেন, শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও পারঙ্গমতার মাত্রা অনুযায়ী শিখন কৌশল প্রয়োগ করবেন। শিক্ষক সকল শিক্ষার্থীর বোধগম্য শ্রবণযোগ্য স্বরে পাঠ উপস্থাপন করবেন। তিনি সকল ছাত্রছাত্রীকে সমান সুযোগ দিবেন। শিক্ষার্থীদের নাম ধরে সম্বোধন করবেন। ইতিবাচক ফিডব্যাক প্রদান করবেন। নিজের উন্নয়নের জন্য সহকর্মী এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে পরামর্শ করবেন। সহকর্মীদের সাথে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রাখবেন এবং সকল শিক্ষার্থীর অভিভাবকের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবেন। তাহলেই তিনি শিক্ষক হিসেবে সফল। শিক্ষকের লব্ধজ্ঞান সুন্দরভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মাথায় ঢুকিয়ে দেয়ার নামই শিক্ষকতা। এজন্য শিক্ষক যতই জানুন না কেন, যদি তিনি ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তবে তার জানাটা এখানে অনর্থক ও মূল্যহীন হয়ে যায়।
হ্যাঁ, সবাই ভালো ছাত্র হয় না, তবে সবাই ভালো মানুষ হতে পারে। শিক্ষার লক্ষ্য হলো ভালো মানুষ তৈরি করা। শিক্ষক নিজে মানুষ হিসেবে কতটা আদর্শবান ও ভালো তার ওপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষ হয়ে উঠবে কি না। শিক্ষকতার পেশায় নৈতিকতা খুবই জরুরি। নীতি-নৈতিকতা বোধ জাগ্রত না হলে কারও পক্ষে এ মহান পেশায় থাকা ঠিক নয়। আসলে ছাত্র ও শিক্ষকের সম্পর্কটা হলো আত্মিক। ছাত্রের দেহ, মন ও আত্মার বিকাশ সাধনে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । একজন মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য হবে- ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো সমস্যায় ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা বা দক্ষতা। সব ধরনের পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়া। ছাত্রছাত্রীদের সত্যের পথে চালিত করা। ছাত্রছাত্রীদের সাথে আত্মিক বন্ধন তৈরি করা। আনন্দের সাথে পড়ানো, যাতে করে ছাত্রছাত্রীরা পড়ায় মনোযোগী হয়। শিক্ষাক্রম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা। উপস্থাপনের দক্ষতা। পরিবর্তনশীল মনোভাব। মিষ্টভাষী ও সদালাপী হওয়া। কথায় ও কাজে, পোশাক ও রুচিতে, পেশায় ও কর্তব্য পালনে শিক্ষক হবেন আদর্শবান, ধর্মপ্রাণ, সত্যপ্রিয়, অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। শিক্ষক হবেন রোল মডেল বা আদর্শ, জ্ঞানের উৎস, আনন্দের ভাণ্ডার। সকল শিক্ষকের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি, আলফাডাঙ্গা আরিফুজ্জামান পাইলট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৫/০৪/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়