শিক্ষকদের অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারবেন কিভাবে মুল্যায়ন করবেন
নিজস্ব সংবাদদাতা, ঢাকাঃ সারা পৃথিবীর শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষাবিদদের সুপারিশের ভিত্তিতে দেশে নতুন ধরনের শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম।
নতুন কারিকুলামের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আগে আমাদের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। এখন অনেকগুলো বড় চ্যালেঞ্জ আছে। প্রথমত, এসডিজি বাস্তবায়ন। দ্বিতীয়ত, গ্লোবাল সিটিজেনশিপ। তৃতীয়ত, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত বিশ্বে উপনীত হওয়া। চতুর্থত, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করা।”
“আমরা আগে এই তিনটি শিল্প বিপ্লবের ধারে-কাছেও ছিলাম না। তবে আমরা দেখেছি আমাদের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট স্মার্ট ও পারদর্শী। এই সময়ে যদি আমরা তাদের ভালো শিক্ষা দিতে না পারি সেই ব্যর্থতা আমাদের। কেনিয়া, মিয়ানমারের মতো আমাদের চেয়েও দরিদ্র দেশও আন্তর্জাতিক কারিকুলামে চলে গেছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে ধারণ করতে গেলে কারিকুলাম পরিবর্তনের কোনো বিকল্প ছিল না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এখন যারা ক্লাস ফাইভে পড়ে, তারা যখন চাকরির বাজারে ঢুকবে, তখন তারা দেখবে ৬০% চাকরির ধরন প্রযুক্তির কারণে পাল্টে গেছে। ফলে তাদের শিক্ষা তো সেইভাবে দিতে হবে, যাতে তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতি ধারণ করতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
আগের শিক্ষাক্রমের সঙ্গে বর্তমান শিক্ষাক্রমের তুলনা কি এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “ প্রথম পার্থক্য হলো, এটি যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলাম। আন্তর্জাতিকভাবে মিল রেখে ক্লাস সিক্সে আমরা কিছু যোগ্যতা নির্ধারণ করেছি। ষষ্ঠ শ্রেণিতে এই যোগ্যতাগুলো অর্জন করতেই হবে। এই যোগ্যতা অর্জন করতে পারলেই সে কামিয়াবি হলো। এই যোগ্যতাগুলো আগে পেন্সিল-কলমে নিতাম, এখন বলছি, করে দেখালেও হবে। আগে যেমন ছিল, অজু কীভাবে করতে হয় সেটি লিখে দিতে হতো, এখন বলছি, কেউ যদি করে দেখাতে পারে তাহলেও হবে। কর্মদক্ষতাকে আমরা এখানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।”
নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না, তাহলে এই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন কীভাবে হবে এমন প্রশ্নে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, “শিক্ষকরা ধারাবাহিক মূল্যায়ন করবেন। শিক্ষকদের তো আমরা এমনিতেই নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছি। পাশাপাশি একটা অ্যাপ তৈরি করছি। কীভাবে মূল্যায়ন করতে হবে সেটি জেনেও নিতে পারবে।”
দেশের সকল স্কুল ও সব শিক্ষকের মান এক নয়, ফলে অনেকেই পিছিয়ে পড়বে কি না এ প্রশ্নে অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “আমরা যে অ্যাপ করেছি, সেটি নিয়ে স্বাভাবিক স্কুলগুলোতেও গিয়েছিলাম তারা আসলে অপারেট করতে পারে কিনা দেখতে৷ সেখানে আমরা দেখেছি, তারা পারে। কিছু সংশোধনীর প্রয়োজন হয়েছিল, সেটি করেছি। পরীক্ষামূলকভাবে এই কাজ চলছে। আশা করি অসুবিধা হবে না। ফলে কেউই পিছিয়ে পড়বে না।”
ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও পরীক্ষার মূল্যায়ন শিক্ষকের হাতে থাকায় ক্ষমতা ও এর অপব্যবহার হতে পারে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটি একটা ডিবেটিং প্রশ্ন! এটি হতেই পারে। শিক্ষকরা প্র্যাক্টিক্যালে ২৫-এর মধ্যে ২৫ দিয়ে দিচ্ছেন। সেখানে এটির সম্ভাবনা থেকেই যায়। প্রভাবশালী অভিভাবকরা শিক্ষকদের চাপ দিয়ে সন্তানের জন্য বেশি মার্ক নিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারেন। এগুলো অমূলক নয়, হতে পারে। আবার ধারাবাহিক মূল্যায়নটাও প্রয়োজন। অনেকদিন ধরে আমরা চেষ্টা করছি। আপনার বাচ্চা যে পারে নাই, সেটি তো আপনি বছর শেষে বুঝতে পারতেন। তার ফলে যে ক্ষতি হওয়ার সেটি হয়েই যেতো। এখন সঙ্গে সঙ্গে আপনি জানবেন। সংশোধনের সুযোগ থাকবে। একটা স্কুলে একজন স্ট্যান্ড করেছে, আর ৪০ জন ফেল করেছে। এটা তো আমরা চাচ্ছি না। আমরা যেটা চাচ্ছি, একটা স্কুলে ৫০টা বাচ্চা থাকলে সবাই যেন একসঙ্গে বেড়ে উঠতে পারে। ভয়ে থাকলে তো হবে না। দেখি না কী হয়? শিক্ষকদের কিছু স্বাধীনতা দেওয়ারও তো প্রয়োজন আছে। আমরা তো এখনই পাবলিক পরীক্ষায় যাচ্ছি না।”
নতুন শিক্ষাক্রমের কারণে প্রাইভেট বা কোচিং উৎসাহিত হবে কি না প্রশ্নে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, “হতে পারে। যদি এমন হয় তাহলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা তো বিকল্প ব্যবস্থা নিতেই পারি। আমরা যে কারিকুলাম করেছি, সেখানে ধারাবাহিক মূল্যায়নটা যায়। একটা চর্চার মধ্যে না গেলে আমরা কীভাবে বুঝবো ভুল হয়ে গেল সিদ্ধান্তটা?”
নবম শ্রেণি থেকে গ্রুপ তুলে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “বিশ্বের অন্তত ৭০ শতাংশ দেশে মাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো গ্রুপ নেই। আমরা চাচ্ছি, এসএসসি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী একই ধরনের জ্ঞান ও যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠুক। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব বিষয়ের উপর তাদের বেসিক জ্ঞানটা যেন থাকে। আগে যারা কমার্সে ছিল, তাদের সায়েন্সের কোনো জ্ঞানই ছিল না। অন্যদের ক্ষেত্রেও তাই। এটি তো আমাদের সিদ্ধান্ত না, সারা পৃথিবীর শিক্ষাক্রমের আলোকে শিক্ষাবিদদের সুপারিশের ভিত্তিতে এটি করা হয়েছে। ২০০৫ সালে যখন একমুখী শিক্ষা করা হলো, তখন জাফর ইকবাল স্যার এর বিরুদ্ধে ছিলেন। এখন কিন্তু সময়ের প্রেক্ষিতে তিনি এর পক্ষে। সময়ই বলে দেয় কী করতে হবে।”
পর্যাপ্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়াই শিক্ষাক্রম চালু হলো কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “আগে কারিকুলাম করে তারপর আমরা বাস্তবায়নে গেছি। এবারই প্রথম শিক্ষাক্রম শুরুর আগে মাঠ পর্যায়ের সকল শিক্ষককে, শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করেছি। তারপর জানুয়ারিতে এসে এটি শুরু করেছি। আমরা চাচ্ছি, শিক্ষকদের ট্রেনিংটাও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে হবে। উনারা শুক্রবার ও শনিবার ট্রেনিংয়ে আসছেন। আর ৫ দিন ক্লাস নিচ্ছেন। ফলে ক্লাসে কী ধরনের সমস্যায় পড়ছেন, পরের শুক্রবার ও শনিবার এসে সেগুলো বলছেন। এটি আমরা ইচ্ছে করেই করেছি।”
বই লেখা বিতর্কের বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, “আগের দিনগুলোতে যত কম সময় দিয়েছিলাম, এবার কিন্তু পর্যাপ্ত সময় দিয়েছি। এবার কিন্তু তারা পর্যাপ্ত সময় পেয়েছেন। তারপরও শিক্ষাক্রমটা নতুন। এর আলোকে কনটেন্টটা কীরকম হবে এটি একটু সময় নিয়ে করা হয়েছে। আমরা তো ১৯৮৬ সালেও করেছি, ১৯৯৫ সালেও করেছি, ২০১২ সালেও করেছি। নতুন শিক্ষাক্রম চালু হলে তার জন্য যে পাঠ্যপুস্তক রচনা হয় সেটি প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে যায়। এরপর ট্রাই আউট হয়। ট্রাই আউট হলো, সকলের মতামত নেওয়া হয়। শ্রেণি কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করা হবে। সবকিছু পর্যবেক্ষন করে যদি দেখা যায় বাংলার একটা গল্প ৮০ ভাগের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে কঠিন মনে হয় তাহলে এটি একটু সহজ করা হবে।”
পরীক্ষামূলকভাবে চালানোর কারণে শিশুরা কোনোভাবে গিনিপিগ হবে কি প্রশ্নে অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বলেন, “আমরা যে পাইলটিং করেছি, সেই রেজাল্ট তো পজিটিভ। এ কারণেই তো বইটা আমরা দিয়েছি। প্রথম ৯ মাসের রেজাল্টের ভিত্তিতে এটি আমরা করেছি। একেবারে গিনিপিগ বলবেন, সেটা ঠিক হবে না। তারপরও নানান জনের নানান অভিমত তো থাকবেই। সবার মতামত আমাদের শোনা উচিত। এটি কিন্তু শুধু আমাদের দেশে না, সারা পৃথিবীতেই এভাবেই হয়।”