শিক্ষকতায় কেন আসবেন
মোস্তফা কামাল :
সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করলাম। আগামী ৬ সেপ্টেম্বর এই পদে ১৩৭৮ জন শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হবার কথা রয়েছে। আমার স্বল্প অভিজ্ঞতার আলোকে এই পদের কিছু সুযোগ/সুবিধা নিয়ে আলোচনা করলাম। পরবর্তী পোস্টে অসুবিধা এবং প্রস্তুতি নিয়ে লিখব। আশা রাখি উপকৃত হবেন।
১। স্বর্ণকার-চর্মকার, দোকানদার-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-ডিসি-এসপি-ইউএনও-বিচারক, চোর-ডাকাইত-বাটপার, কুলি-মজুর-কৃষক-বেকার-আকার, ভালো মানুষ-খারাপ মানুষ সবাই চায় তার ছেলে-মেয়ের মাধ্যমিকের লেখাপড়াটা আপনার স্কুলেই হবে। তাই নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ওয়াজ মাহফিলের বক্তা না হয়েও যে সেলিব্রেটি হওয়া যায় তার একমাত্র উপায় হলো শিক্ষকতার চাকরি।
২। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষকের বাহিনীর মত কাজ করে, তারা আপনার নেটওয়ার্ক, আপনি তাদের সাথে বন্ধু সুলভ আচরণ করে পাঠদান করাতে পারলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক এবং এলাকাবাসী আপনাকে যথেষ্ট সম্মান করবে। স্কুলগুলোতে এখনো রাজনীতির কোন বালাই নাই ফলে ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক ধরে রাখা সহজ হয়।
৩। আপনি সরকারের একজন ২য় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তা হবেন।
৪। ১৬০০০/-টাকা বেসিকে স্বাস্থ্যভাতা, বাড়িভাড়া সহ প্রায় ২৫০০০/- টাকা বেতনে কর্মজীবন শুরু হবে, প্রতিবছর ৫% ইনক্রিমেন্ট সহ সরকারী সকল সুযোগ সুবিধা পাবেন। আপনি যদি ভালো পড়াতে পারেন তাহলে আশেপাশের স্কুলের কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ব্যাচে পড়ানোর নিয়ম আছে এবং তাতে যা পাবেন সচ্ছলভাবেই আপনার সামাজিক জীবন চলে যাবে।
৫। জে এস সি, এস এস সি এবং একাডেমিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন এবং ডিউটির জন্য সম্মানী পাবেন, জেলা পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষা গুলোর ডিউটি এবং খাতা মূল্যায়ন বাবদ সম্মানী পাবেন, দেশের সকল সরকারী মাধ্যমিক স্কুলে টিফিনের ব্যবস্থা আছে যৎসামান্য মূল্যে সে টিফিনের ব্যবস্থাও আপনার জন্য করা হবে।
৬। পাঁচ বছর কর্মজীবন পূর্ণ হলে আপনি গৃহনির্মাণ/জমি ক্রয়ের ঋণের আবেদন করতে পারবেন। বেসিক এবং কর্মএলাকা অনুযায়ী কমবেশি প্রায় ৫০,০০,০০০/- টাকা ৫% ইন্টারেস্টে ঋণ পাবেন, যা পরবর্তীতে মাসিক বেতন থেকে ধীরে ধীরে সমন্বয় করা হবে।
৭।মুক্ত আকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের সাথে হৈ-চৈ করে প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে আনন্দঘন জীবন কাটাতে পারবেন। জেএসসি, এসএসসির রেজাল্ট, সপ্তাহব্যাপী জমকালো বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান, বার্ষিক মিলাদ, বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠান, স্বাধীনতা দিবস, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস ইত্যাদি দিবসগুলোতে শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ আপনাকে বিমোহিত করবে।
৮। পাড়া-মহল্লা, মহকুমা, জেলা-উপজেলা যে জায়গাতেই সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় অবস্থিত হোক না কেন এক কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়ে থাকে। ফলে তুলনামূলক ভালো মানসম্পন্ন এবং সচেতন ফ্যামিলির ছেলে-মেয়েরাই হবে আপনার শিক্ষার্থী।
৯। পরিবার এবং সামাজিকতা মেইনটেইন করে চলতে পারবেন কেননা আপনার নিজ জেলাতে পোস্টিং হবার সম্ভাবনাই বেশি।
১০। আপনি আপনার ছাত্রের স্যার, তার বাবা-মায়ের স্যার, তার দাদা-দাদি, পাড়া-পড়শিরও স্যার। প্রতিনিয়ত তারা আপনাকে সম্মানের সহিত সালাম দিবেন। মুখের উত্তরে সালাম ফিরাইতে-ফিরাইতে আপনার এমন হবে যে শেষপর্যন্ত দুই হাত তুলে সালাম ফিরাইতে হবে। এটি সমাজে শুধু আপনারই প্রাপ্য, অর্থবিত্তের সাথে এর কোন সম্পর্ক নাই।
১১। আপনি যা শেখাবেন, শিক্ষার্থীরা সেটাই শিখবে। তারা দেশে-বিদেশে আলোর দ্যুতি ছড়াবে তার মানে আপনার আদর্শ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাবে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বহুক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বাবা-মায়ের চেয়েও শিক্ষকের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেয় এবং আস্থা রাখে।
অর্থ-বিত্ত, শানসওকাত আর আতিশয্যের দিকে না তাকিয়ে সম্মান, সামাজিকতা আর জাতির ক্রান্তিকালের কারিগর হতে চাইলে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি আপনার জন্য বেস্ট অপশন বলে আমি মনে করি। আলহামদুলিল্লাহ্, প্রায় আড়াইগুণ বেতনের ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে শিক্ষকতায় এসে একটিবারের জন্যও মনে হয়নি যে আমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আপনাদের দোয়ায় আমি ভালো আছি।