মেধা-মনন বিকাশে শিশুর নিরাপত্তা
ঢাকাঃ আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। প্রতিটি শিশুর জন্ম মায়ের গর্ভেই। ভুমিষ্ট হওয়ার পর মা কত আদর যত্নে বড় করে বুকের ধন শিশুকে। কত স্বপ্ন দেখে আদরের সন্তানকে ঘিরে। যখন অসুখ বিশুখে কিম্বা অন্য কোন কারণে শিশুর কষ্ট হয়, তখন মায়ের কত রাত যে বিনিদ্র কেটে যায়, তা প্রতিটি মায়ের ক্ষেত্রেই সমান।
ধনী, গরিব, নির্ধন কিম্বা অতি বিত্তশালীর ঘরের সন্তানটি যেমন মায়ের কাছে আদরের, তেমনি দিন ভিখারীর শিশুটিকেও মা নিজে না খেয়ে সন্তানকে খাইয়ে ঘুম পাড়ায়। এভাবেই আমরা সকলেই মায়ের যত্নেই বড় হয়ে আবার নিজের সন্তানকে শত প্রতিকূলতার মাঝেও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা দীক্ষায় বড় করে তুলি।
আমাদের দেশে বর্বরতা কল্পনার সীমাকে অতিক্রম করেছে অনেক আগেই। আমরা দাবী করি, বিংশ শতাব্দির সভ্য যুগে আমাদের বসবাস। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন, মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন, সব দিক থেকেই জাতি হিসেবে আমাদের অর্জন খুব যে একটা কম, তা বলা যাবে না। প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হয়েছে ৫২ বছর আগে। শিক্ষা দিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশটি এখন বেশ অনেক দুর এগিয়েছে।
যদিও সে শিক্ষা ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। সে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ হয়েছে। শিক্ষাকে ঘিরে বাণিজ্য হলেও সরকার সে দিকে নজর দিচ্ছে না। উল্টো শ্রেণি স্বার্থ রক্ষার সুবাদে গুটিকতক মানুষ মেডিকেল কলেজ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সহ নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে চুঁটিয়ে ব্যবসাও করছেন। তখন শ্রেণি স্বার্থেই সরকার টু’শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করে না।
এরপরও মানুষ শিক্ষা গ্রহণের অদম্য আকাক্সক্ষা নিয়ে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ হারিয়ে অতিকষ্টে বাড়তি ব্যয়ে নিজের সন্তানটিকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করাতে বাধ্য হন। যদিও পড়াশোনা শেষে বেঁচে থাকার অন্যতম নিয়ামক কর্মসংস্থানের সুযোগও অনেকের ভাগ্যে জোটে না।
ক্ষমতাসীনদের কতই না প্রতিশ্রুতি! ক্ষমতায় যেতে পারলে কর্মসংস্থানের দ্বার সম্প্রসারিত করা হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীন হয় ঠিকই, দু’এক বছর ন্যাশনাল সার্ভিসের মতো প্রকল্পের আওতায় মাসিক ন্যুনতম ভাতার সুযোগ পেলেও নির্দিষ্ট সময়সীমার পর আবারও সেই বেকারত্বের অভিশাপ! সরকার যায় সরকার আসে, কিন্তু কর্মসংস্থানের জন্য শিল্প কলকারখানা তৈরি হয় না।
নির্বাচনী ইশতেহারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির কত সুযোগের কথা তুলে ধরা হয়। কিন্তু ব্যাস, ক্ষমতাসীন হলেই বেমালুম ভুলে যায় সব ওয়াদার কথা! তবে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, ব্রীজ কার্লভাট নির্মাণসহ নানাখাতে উন্নয়ন হয় সত্য। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কর্মসংস্থানের দ্বার উন্মোচিত হয় না। কারণ যারা বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামোর বদৌলতে স্বল্প সময়ে নানাভাবে কাড়িকাড়ি অর্থ কামায়, তারা সে অর্থ দেশে বিনিয়োগ না করে বিদেশে দেদার পাচার করে। ফলে দেশে বিনিয়োগ বাড়ে না।
আর বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হয় না। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে সভ্য সমাজের চাকচিক্য, বিলাস-বৈভবকে পাল্লা দিতে অনেকেই হয়ে যায় ছিনতাইকারী কিংবা অপহরণকারী। নিষ্পাপ শিশুদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো জঘন্য কাজে অনেকেই জড়িয়ে পড়ছে। যাদের রোষানলের শিকার হয়ে কত নিষ্পাপ শিশুর জীবন বিপন্ন হচ্ছে।
শুধু অর্থের কারণেই নয়, অনেক সময় পারিবারিক দ্বন্দের কারণেও নিষ্পাপ শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হচ্ছে। যে দেশে নিষ্পাপ শিশুর নিরাপত্তাটুকু বিঘ্নিত হতে পারে, আর যাই হোক, সে দেশে যে মানবতা প্রতি পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা অস্বীকার করবেন কি করে? আমরা এমনি একটি মানবতাহীন, বিচারহীন রাষ্ট্র কাঠামোয় বসবাস করছি।
কয়েক বছর আগের কথা, নারায়নগঞ্জের রূপগঞ্জে জুঁই আক্তার নামে তিন বছর বয়সী এক শিশুকে অপহরণ করা হয়। তিনদিন পর ওই শিশুর বাড়ীর পেছন থেকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রশ্ন হলো, কি অপরাধ থাকতে পারে তিন বছরের শিশুটির? অথচ নিষ্পাপ শিশুটিকে হাত পা বেঁধে হত্যা করা হয়েছিল।
যে পাষন্ডরা তিন বছরের শিশুকে হত্যা করতে পারে, তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার আইনে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরী। কিন্তু বিলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার কারণে অনেক সময়ই অপরাধিরা বেপরোয়া হয়ে যায়। ফলে শিশু অপহরণ অতপর খুন, কিংবা শিশুধর্ষণ রোধ হয় না। যারা নিষ্পাপ শিশুদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে পারে, তারা মানুষ নামের অমানুষ! দিন দিন এসব অমানুষের রোষানলে পড়ে কত নিষ্পাপ শিশুকে বিদায় নিতে হচ্ছে দুনিয়া থেকে।
অথচ এরাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম। সম্ভাবনাময় এসব শিশুদের রক্ষা করতে না পারলে দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে। অথচ ভবিষ্যত প্রজন্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। যদি রাষ্ট্র এ কাজে অপারগ হয়, তাহলে রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে যাবে। অথচ অপরাধিদের ধরে আইনের আওতায় এনে বিচার কার্য নিশ্চিত করতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করলেও শিশু অপহরণকারী অপরাধিদের শাস্তি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ নিয়ে প্রতিটি পরিবারকে এক ধরনের শংকা নিয়েই দিনাতিপাত করতে হয়। ফলে বাবা মায়েরা নিজেই আদরের শিশুটিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে অপেক্ষা করে। স্কুল শেষে সন্তানটিকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ী ফিরে। সেখানেও বিপত্তি! অনেক সময়ই বাবা মায়ের কোলে থাকা শিশুদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হয়। কোন কোন সময় বাবা মায়ের কাছ থেকে শিশু ছিনিয়ে নেয়া হয়। আবার কোন সময় দুর্ঘটনার শিকার হয়ে বাবা মায়ের কোল থেকে ছিটকে পড়ে আদরের সন্তানকে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়।
এ ধরনের ঘটনা মাঝেমধ্যেই ঘটে। ফলে শিশুদের মধ্যেও একধরনের শংকা কাজ করায় ওদের মেধা-মনন বিকাশ বিঘ্নিত হয়। শিশুর মেধা-মনন বিকাশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার পাশাপাশি শিক্ষা অর্জনের উপযুক্ত পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশে যে পরিমাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন পর্যন্ত স্থাপিত হয়েছে, এতে সকল শিশুর শিক্ষার সুযোগ শতভাগ নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি।
ফলে নিভৃত পল্লী থেকে শুরু করে মফস্বল শহর কিম্বা উপজেলা ও জেলা শহরে যত্রতত্র বেসরকারি উদ্যোগে কিন্ডার গার্ডেন, ক্যাডেট স্কুল কিংবা মাদ্রাসা স্থাপন করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার পরিবেশ, উপযুক্ত শিক্ষক কিংবা শিক্ষার নানা উপকরণের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই তার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না।
এমনকি এসব প্রতিষ্ঠান কোন বাড়ী কিম্বা ঘর ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত খেলার মাঠও নেই। অর্থাৎ খেলাধুলার সুযোগও নেই। অথচ শিশুদের মেধা মননের বিকাশ ঘটাতে হলে পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলারও সুযোগ থাকতে হবে। কারণ খেলাধুলা ব্যতিত শিশুদের মেধা ও মননের বিকাশ বাধাগ্রস্থ হবে। শুধু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বলবো না, অনেক ক্ষেত্রে ছাত্র/ছাত্রীর সংখ্যা অনুপাতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও উপযুক্ত খেলার মাঠ নেই।
অথচ শিক্ষা প্রসারে সরকার প্রতিবছরই নতুন পাঠ্যবই সরবরাহ, শিশুদের অনুকূলে ভাতা, টিফিনের ব্যবস্থা করলেও শতভাগ শিশুকে স্কুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এখনও অনেক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। মুলত দরিদ্র বাবা মায়ের সংসারের বোঝা টানতেই অনেক কমলমতি শিশুকে শ্রম বিক্রি করতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও যারা শিক্ষা গ্রহণ করার বদলে কলকারখানায়, ছোট ছোট দোকানে কিম্বা ফ্যাক্টরিতে শারীরিক শ্রম বিক্রি করছে।
বিশেষ করে মহামারি করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে গেছে। পরিবারের আয়-রোজগার না থাকায় অনেক শিশুই এখন শ্রম বিক্রি করছে। আর স্বাধীনতার মূল চেতনাই ছিল শিক্ষা সমৃদ্ধ জাতি গঠন করার। অথচ স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশক অতিবাহিত হলেও আজও শিক্ষার অধিকারকে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। উল্টো শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ হয়েছে, যা আগেই বলেছি।
প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও কারিগরি, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বেসরকারিভাবে স্থাপন করা হচ্ছে শুধু বাণিজ্যের কারণে। যেখানে বাড়তি খরচ ছাড়া লেখাপড়ার কোন সুযোগ জোটে না। অথচ শিক্ষা সার্বজনিন। সার্বজনিন এই শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা একান্তভাবে জরুরি।
অর্থাৎ কোন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকবে না। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারিকরণ করে সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর যদি তা করা সম্ভব না হয়, তাহলে শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ বন্ধতো হবেই না, উল্টো এ প্রবণতা আরো বেড়ে যাবে। অথচ সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শিক্ষার যেখানে বিকল্প নেই, সেখানে শিক্ষার প্রসার সম্প্রসারিত হচ্ছে না।
অনেক ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হলেও দীর্ঘ সময়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা হয়নি। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। বৈষম্যমুলক শিক্ষা ব্যবস্থার কারণে শিক্ষা অর্জনের মূল কারিগর শিক্ষক সমাজকেও বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। নানা সময়ই শিক্ষকরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করলেও কাক্সিক্ষত দাবি দাওয়াও পূরণ হচ্ছে না।
মুলত বৈষম্যমুলক শিক্ষা ব্যবস্থার শিকার হতে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ছেলে মেয়েদের। আমরা মনে করি, সকল শিশুর মৌলিক অধিকার শিক্ষা অর্জনে শিশুর নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি শিক্ষার কারিগর শিক্ষক সমাজের বেতন বৈষম্য দুর করে পাঠদানের উপযুক্ত পরিবেশকেও নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষকরে ভয়-ভীতিহীন অবস্থায় শিশুদের পাঠদান কার্যক্রমকে পরিচালনা করা উচিৎ। এখন দেখা যায় একটি শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থীর উপর বাড়তি বইয়ের চাপ দেওয়া হচ্ছে। মনে হয় প্রথম শ্রেণীর শিশু শিক্ষার্থীকে এখন বাংলা, অংক এমনকি ইংরেজি ও আরবি শিক্ষায় গড়ে তুলতে হবে। ফলে ছোট একটি শিশুকে প্রথম শ্রেণীতেই রাত দিন পড়াশুনা করতে হয়। মনে হয় শিশুটির পর্যাপ্ত ঘুমও যেন হয় না।
ফলে বাড়তি পড়ালেখার চাপে শিশুরা অনেক সময়ই নির্বোধের মতো হয়ে যাচ্ছে। আমরা মনে, করি শিশুদের বইয়ের বাড়তি বোঝা কমিয়ে সহনশীল মাত্রায় শিক্ষা দেয়া উচিৎ। মনে রাখতে হবে, শিশুদেরও পড়াশুনা করে তা আমলে রাখারও একটা সক্ষমতার মাত্রা আছে। যাকে কোন ভাবেই অবজ্ঞা করা উচিৎ না। তা না হলে শিশুদের মেধা মনন বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। যা কোনভাবেই কারো কাছে কাম্য হতে পারে না।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়