মামলা থাকলেও ধুনটে মাদ্রাসায় ১৮ লাখ টাকায় গোপনে নিয়োগ
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ নিয়োগ যোগ্য পদের বিপরীতে মামলা কিংবা বিদ্যমান পরিচালনা কমিটির বিরুদ্ধে মামলা থাকলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ না থাকলেও অতি গোপনে পদের বিপরীতে থাকা মামলা গোপন করে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বগুড়ার ধুনট উপজেলার নাংলু এম, কে, এম ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩ অক্টোবর ২০২২ সালে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। মোট ১২ জন আবেদন করে। নাংলু এম, কে, এম ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোঃ মাসুদ আলম আবেদনকারীদের মধ্যে মোঃ সাখাওয়াত হোসেনকে নিয়োগ দিতে তোরজোড় শুরু করলে অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। আর এই নিয়োগ নিয়ে একক প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সভাপতির একচ্ছত্র তোরজোড় দেখে নিয়োগ প্রার্থী মোছাঃ সোমা আক্তার ৫ জুলাই ২০২৩ ইং তারিখে বগুড়ার ধুনট থানা সহকারী জজ আদালতে গভর্নিং বডির সভাপতি অধ্যাপক ড. মোঃ মাসুদ আলমকে বিবাদী করে মামলা দাখিল করেন। মামলা নম্বর ১৪১/২০২৩ অন্য। বর্তমানে মামলাটি চলমান রয়েছে।
শুধু তাই নয়, মোঃ সাখাওয়াত হোসেন নামের যে প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে গত ২২ জুন ২০২৩ তারিখে সেই প্রার্থীর কাছ থেকে অগ্রিম প্রায় ২০ লাখ টাকা ঘুষ লেনদের অভিযোগ এনে স্থানীয় এক ব্যক্তি মাদ্রাসা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন। অভিযোগ জমা দানের ডকেট নম্বর ৮৪৬৫।
মাদ্রাসার একাধিক সূত্র জানায়, গত ১৯ মার্চ ২০২৩ ইং তারিখে কোনো রেজুলেশন ছাড়া মাদ্রাসাটির সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ রেজাউল করিম সরকারকে শোকজ না করেও একটি শোকজ করা হয়েছে জানিয়ে ২৬ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন এবং বিধিবহির্ভুতভাবে মাদ্রাসার বাংলার সহকারী অধ্যাপক মোঃ ফজলুল করিমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করেন শুধুমাত্র অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ বাণিজ্য করার লক্ষে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে আরবি বা ইসলামী বিষয়সমূহের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও জেনারেল শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা বিধি লঙ্ঘন বলছে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীতে বিধিবহির্ভুত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে দিয়ে পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন সভাপতি। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে মাদ্রাসা অধিদপ্তর থেকে ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে কবে পুনঃবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে, কবে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে সে বিষয়ে মাদ্রাসাটির কোন শিক্ষক, কর্মচারী কেউ-ই জানেন না। নিয়মানুযায়ী, পুনঃবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে পূর্বের আবেদনকরা প্রার্থীদের পুনরায় আবেদন করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু পূর্বের আবেদন করা প্রার্থীদের কারও নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে জানানো হয়নি। শিক্ষাবার্তা'র সাথে আলাপকালে প্রার্থীরা বলেন, আমাদের জানানো হয়নি। এমনকি আমরা যে পুনরায় আবেদন করব সে বিষয়ে এত গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে যা আমরা কেউই জানতে পারিনি।
মাদ্রাসা অধিদপ্তর জানায়, ২০১৮ সালে জারীকৃত জনবল কাঠামো সংক্রান্ত সংশোধিত পরিপত্রের পরবর্তী কোন সংশোধনী থাকলে তা যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে এবং নিয়োগ যোগ্য পদ ও কমিটি নিয়ে মামলা থাকলে সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগের সুপারিশ করা যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে ডিজি মনোনীতি প্রতিনিধির বিরুদ্ধে পরিপত্র মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিয়োগ যোগ্য উপরক্ত পদের বিপরীতে মামলার বাদীর স্বামী মোঃ ইবনে সাউদ। তিনি সাখাওয়াত হোসেন নামের প্রার্থীকে ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে সভাপতি নিয়োগ দেওয়ার জন্য যে পায়তারা করছেন সে বিষয়ে গত ২২ জুন ২০২৩ তারিখ অধিদপ্তরের ডিজির বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। যার ডকেট নম্বর ৮৪৬৫। এরপর মামলার কপি অধিদপ্তরের জমা দেন ৯ জুলাই ২০২৩ ইং তারিখে। যার ডকেট নম্বর-৮৯২৯। অর্থ্যাৎ নিয়োগ যোগ্য পদের বিপরীতে মামলা থাকা অবস্থাতেও বিধিবহির্ভূতভাবে ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং যে প্রার্থীর বিরুদ্ধে ১৮ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে তাকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের দপ্তর বলছে, নিয়োগ যোগ্য পদের বিপরীতে কোন মামলা নেই এবং বিদ্যমান কমিটির বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই তা জানিয়ে ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সভাপতি এবং অধ্যক্ষের যৌথ স্বাক্ষরে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে। এখানে পদের বিপরীতে মামলা থাকলে তাতে নির্দেশনা যাই থাকুক বা মামলা শুনানীর অপেক্ষায় থাকুক না কেন তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়ার বিধান নেই।
কবে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে জানতে শিক্ষাবার্তা'র পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় মাদ্রাসাটির একাধিক শিক্ষকের সাথে। আরবির সহকারী অধ্যাপক আরিফুর রহমান এবং ইংরেজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, কবে পুনঃবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, কবে পরীক্ষা হয়েছে তা তারা কিছুই জানতে পারেননি।
গভর্নিং বডির শিক্ষক প্রতিনিধি এবং সমাজ বিজ্ঞানের সহকারি শিক্ষক মাহফুজা রহমান বলেন, আমি নিয়োগের সাথে সম্পৃক্ত নই। এ বিষয়ে সভাপতি এবং ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ভালো বলতে পারবেন। আমি কিছু জানি না।
আরেক শিক্ষক প্রতিনিধি আক্তার নাহার। তিনি জানান, আমি কমিটির সদস্য হলেও বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু জানিনা।
সহকারি মৌলভী মোহাম্মদ আলী বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
কমিটির সহ সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, আমি মাদ্রাসাটির একজন দাতা, কমিটির সহসভাপতি, এছাড়াও মাদ্রাসার সাথে লাগোয়া আমার বাড়ী। অথচ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার কিছুই আমি জানি না। এই নিয়োগ জালিয়াতি করতেই অধ্যক্ষকে অকারণে বরখাস্ত করে অবৈধ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে প্রায় ১৮ লাখ টাকা নিয়ে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নিয়োগ পাওয়া প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেন শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, কবে পরীক্ষা দিয়েছি মনে নেই। তবে তিন জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। অনেক পয়সা খরচ করে চাকরিটা নিতে হয়েছে। এটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাংলু এম, কে, এম ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা যে ওয়ার্ডে অবস্থিত সেই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো: আব্দুল বাছেদ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, নিয়োগ পরীক্ষা তো গোপনের বিষয় না অথচ এই নিয়োগের বিষয়ে আমরা কেউই জানি না। মাদ্রাসার পাশের বাড়ির যে ব্যক্তি সেও জানে না। বাস্তবে এই মাদ্রাসায় এই নিয়োগ পরীক্ষা হয় নাই। ১৮ লাখ টাকার বিনিময়ে আগেই চূড়ান্ত করে রাখা প্রার্থীকে অতি গোপনে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই নিয়োগ মাদ্রাসার বাইরে বসে দেওয়া হয়েছে।
মাদ্রাসাটির পার্শ্ববর্তী বাড়ি এমন অন্তত ১৫ জন ব্যক্তির সাথে কথা হয় শিক্ষাবার্তা'র। তবে তাদের কেউই জানতে পারেননি কবে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল, কবে নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের দাবি, এই নিয়োগ বাতিল করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ এবং পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হোক।
কবে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে জানতে চাইলে মাদ্রাসাটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোঃ ফজলুল করিম প্রথমে ২৬ থেকে ২৮ অক্টোবরের মধ্যে নিয়োগ পরীক্ষা হয়েছে তবে সঠিক তারিখ মনে নেই জানিয়ে পরের দিন পুনরায় বলেন ২১ অক্টোবর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনার মাদ্রাসায় যে অফিস সহকারি পদের নিয়োগ প্রদান করেছেন সে পদের বিপরীতে মামলা থাকার বিষয়ে জানতেন কি'না জিজ্ঞাস করলে তিনি বলেন, জানতাম। নিয়োগ যোগ্য পদ ও কমিটি নিয়ে মামলা থাকলে সংশ্লিষ্ট পদে নিয়োগের সুপারিশ করা যাবে না এমন বিধির কথা উল্লেখ কললে তিনি বলেন, নিয়োগ দেওয়া যাবে কি'না তা নিয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরা নিয়োগ দিয়েছি। ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগের জন্য করা আবেদনে নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে কোন মামলা নেই মর্মে লিখিত দিতে হয় সেখানে আপনারা বিষয়টিকে কিভাবে গোপন করলেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, বিষয়টি সভাপতি ভালো বলতে পারবে।
ধরুন আদালতে নিয়োগ বাতিলের রায় আসলো সেক্ষেত্রে নিয়োগ পাওয়া অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের কি হবে এমন প্রশ্নে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, আসলে বিষয়টি সে জেনেই এসেছে। চাকরি না থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। তিনি বলেন, সভাপতির সাথে কথা বলেন বিস্তারিত জানতে পারবেন।
এ বিষয়ে নাংলু এম, কে, এম ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোঃ মাসুদ আলম শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, বিধিমোতাবেক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গত ২১ অক্টোবর এই নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
জানতে চাইলে ধুনট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ একরামুল হক সরকার শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, নিয়োগ যোগ্য পদের বিপরীতে মামলা আছে শুনেছি। সার্বিক বিষয়ে খোজ খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিয়োগের মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ডিজি প্রতিনিধি অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবু জাফর শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, মামলার বিষয়টি আমি পরে জেনেছি। নাংলু এম, কে, এম ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে বিষয়টি জানালে তিনি জানান, ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগ আবেদনের পরে মামলা করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে ৫ জুলাই ২০২৩ তারিখে এবং মাদ্রাসা অধিদপ্তরে মামলার বিষয়টি জমা দেওয়া হয়েছে ৯ জুলাই ২০২৩ ইং তারিখে। যার ডকেট নম্বর-৮৯২৯। তাহলে তারা কিভাবে এই মিথ্যার আশ্রয় নিলেন বললে তিনি বলেন, আসলে আমাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে আমি তার প্রেক্ষিতে গিয়েছি। এই বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব।
মাদ্রাসা অধিদপ্তরের ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগের চিঠি ইস্যু করেন সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ শাহীনুর ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কোন সাড়া দেননি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৯/১১/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়