মাধ্যমিকে ক্লাসে নয়, কোচিংয়ে জোর
শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ দেশের ৩০ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুর্বল বা স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে কোনো যত্ন নেওয়া হয় না। যদিও দুর্বলদের বেছে বেছে বাড়তি যত্ন নেওয়ার নির্দেশনা আছে সরকারের এবং এটা নিশ্চিত করা স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের দায়িত্ব।
-
প্রতিবেদনের আওতায় আসা বিদ্যালয় ৬৮৭২টি।
-
৫২৭টি বিদ্যালয় দুব৴ল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে না।
-
১৫০৭টি বিদ্যালয় দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করলেও যত্ন নেয় না।
-
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণেও ঘাটতি।
স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা করে যত্ন নিলে অকৃতকার্য হওয়ার হার কমে। ঝরে পড়াও কমে যায়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষকদের বড় অংশ শ্রেণিকক্ষে আলাদাভাবে যত্ন নেওয়ার বদলে অর্থের বিনিময়ে ব্যক্তিগতভাবে পড়াতেই (কোচিং ও প্রাইভেট) বেশি আগ্রহী। তাঁরা স্কুলে বাড়তি সময় দিতে চান না। স্কুলগুলো অবশ্য অজুহাত হিসেবে শিক্ষকস্বল্পতার কথা সামনে আনে।
স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের প্রতি নজর না দেওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) শিক্ষাবিষয়ক তদারকি প্রতিবেদন বা একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টে। কয়েক মাস পরপরই এ প্রতিবেদন তৈরি করে মাউশির অ্যাকসেস অ্যান্ড কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স (অভিগম্যতা ও মান নিশ্চিতকরণ) ইউনিট।
মাউশি গত সেপ্টেম্বরে ৬ হাজার ৮৭২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় তদারক করে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে দেখা যায়, ২২ শতাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় (১৫০৭টি) স্বল্প কৃতিধারীদের চিহ্নিত করলেও কোনো পদক্ষেপ নেয় না। আর প্রায় ৮ শতাংশ বিদ্যালয় (৫২৭টি) স্বল্প কৃতিধারীদের চিহ্নিতই করে না।
দেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৮ হাজার ৮৭৪। গত মে মাসেও একই প্রতিবেদনে একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছিল। এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তৈরি করা প্রতিবেদনে হারটি ছিল ৪১ শতাংশ। মাউশি ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে তদারক করে। সব ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সারা দেশের প্রতি তিনটি স্কুলের একটিতে স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের আলাদা যত্ন নেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অভিযোগ রয়েছে, শুধু প্রতিবেদনই তৈরি করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
মাউশি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০–এর আলোকে এই তদারকি প্রতিবেদন করে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রকল্পের (সেসিপ) অধীনে। প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়বস্তু ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে যে ঘাটতি আছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় সেসিপের যুগ্ম কর্মসূচি পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব)
অধ্যাপক সামসুন নাহারের কথায়ও। তিনি বলেন, প্রতিবেদন পাওয়ার পর তার আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাঁরা মাউশির আঞ্চলিক পরিচালকদের চিঠি দেন। তবে অনেক সময় সমন্বয়হীনতার কারণে তদারকির কাজে অসুবিধা হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে প্রকল্পের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত একাডেমিক সুপারভাইজাররা রাজস্ব খাতের নয়। ফলে তাঁদের সঙ্গে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের অনেক সময় সমন্বয়হীনতা হয়।
বিষয়টি নিয়ে মাউশির বক্তব্য জানতে গতকাল সোমবার সংস্থাটির মহাপরিচালক নেহাল আহমেদের দপ্তরে গেলে তিনি বলেন, আগে খুব একটা ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। এখন নিয়মিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি শিক্ষকসংকটের বিষয়টিও তুলে ধরেন।
স্বল্প কৃতিধারী কারা
শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা কোনো বিষয়ে বা বিষয়গুলোতে ৩০ শতাংশের কম নম্বর পেয়েছে এবং যারা ধারাবাহিক মূল্যায়নে (সিএ) ভালো করেনি, সেসব শিক্ষার্থীকে স্বল্প কৃতিধারী হিসেবে গণ্য করা হয়। মাউশির নিয়মানুযায়ী, এ ধরনের শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করবেন বিষয় ও শ্রেণিশিক্ষক। এ তালিকা করার সময় দুর্বল শিক্ষার্থীর নাম, রোল নম্বর, দুর্বলতার কারণ, সহায়তার ধরন ও সহায়তা পাওয়ার ফলাফল ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতে হবে।
মাউশির সর্বশেষ প্রতিবেদনে স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে মাউশির আঞ্চলিক পরিচালক, জেলা ও উপজেলা বা থানা শিক্ষা কর্মকর্তাদের এ সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
মাউশির নিয়মানুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে পরিবীক্ষণ ও তদারক করা হয়। এর মধ্যে এ শ্রেণির (ভালো) বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি তিন মাসে একবার, বি শ্রেণির বিদ্যালয়গুলোকে প্রতি দুই মাসে একবার, সি শ্রেণির বিদ্যালয়গুলোতে দেড় মাসে একবার এবং ডি এবং ই শ্রেণির (দুর্বল) বিদ্যালয়গুলোতে প্রতি মাসে একবার পরিবীক্ষণ ও তদারকির কথা। তদারকির কাজটি করবেন উপজেলা ও থানা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং অন্য কর্মকর্তারা। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিবিড়ভাবে তদারকি হয় না।
রাজধানীর রমনা থানার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, তাঁদের অধীনে মোট ৩৯টি বিদ্যালয় রয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের বেশির ভাগেই দুর্বল শিক্ষার্থীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়। তবে কিছু বিদ্যালয়ে তা নেওয়া হয় না।
শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, যে শিক্ষার্থী যে বিষয়ে দুর্বল, সেই শিক্ষার্থীকে আলাদা করে সে বিষয়ে পড়াতে হবে। সেটা করতে হবে নিয়মিত ক্লাসের বাইরে।
ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের সদ্য সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, এ কাজ করা খুব কঠিন নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। অনেক বিদ্যালয়ে বিদ্যমান জনবলকাঠামো অনুযায়ীই শিক্ষক নেই। সে ক্ষেত্রে বাস্তবে এ কাজ করা বেশ কঠিন। তিনি বলেন, ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের কথাই ধরা যাক। এখানে একেকটি ক্লাসে ৭০ থেকে ৮০ জনের মতো শিক্ষার্থী আছে। এখন দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা করলে সেই পরিমাণ শিক্ষক তো নেই।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন ছুটি চলছে। তবে গতকাল দপ্তরে পাওয়া গেল রাজধানীর সেগুনবাগিচা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহকে। স্বল্প কৃতিধারী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আলাদা পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুর্বল শিক্ষার্থী চিহ্নিত করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু যে সহায়তা দেওয়া দরকার, তা দেওয়া সম্ভব হয় না। শিক্ষকেরা নির্ধারিত সময়ের পর থাকতে চান না। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায় থেকে লিখিত নির্দেশনা থাকলে ভালো হতো।