ভর্তিতে গলাকাটা ফি আদায় করছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল
নিউজ ডেস্ক।।
করোনার ভয়কে অনেকটাই জয় করেছেন অভিভাবকরা। সেপ্টেম্বরে স্কুল খুলে দেওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সন্তান পাঠিয়েছেন তারা। যেসব শিক্ষার্থী আতঙ্কে বাইরে ছিল বছরের শেষে তাদের অনেকে ফিরেছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির কিন্ডারগার্টেন (কেজি) স্কুল ফের বাণিজ্যে নেমেছে। ভর্তি, ড্রেস, বইকেনাসহ নানান খাতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা। সরেজমিন বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে এ চিত্র দেখা গেছে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) মহাপরিচালক আলমগীর মুহাম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও সর্বজনীন। এ কারণে সরকারি স্কুলে কোনো ভর্তি ফিও নেওয়া হয় না। কিন্তু কেজি স্কুলগুলোর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। সেগুলোর ফিও আমরা নির্ধারণ করি না।’
জানা গেছে, এক সময়ে দেশে প্রায় ৬০ হাজার কেজি স্কুল ছিল। এসব স্কুলের জন্য ২০১১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজি) বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা করে। এরপর এগুলো নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ২০১৫ সাল পর্যন্ত চার বছরে মাত্র ৩০২টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করাতে সক্ষম হয় ডিপিই। পরে স্কুলের শুমারি করতে ২০১৬ সালে বিভাগীয় কমিশনারদের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তখন তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিবন্ধন আর শুমারির কোনোটিই হয়নি।
নিবন্ধন না থাকায় স্বাভাবিক কারণেই সেগুলোর ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ডিপিই মহাপরিচালক সোমবার একবাক্যে খোলামেলাভাবে এ বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এসব স্কুলের দৌরাত্ম্য এভাবে চলবে কিনা। এ প্রশ্নের জবাবে ডিপিই মহাপরিচালক বলেন, অভিভাবকদের উচিত হবে বাচ্চাদের সরকারি স্কুলে ভর্তি করা। তাহলে আর সমস্যা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, শিক্ষা আইন হচ্ছে। এটি পাশ হলে তখন অবশ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে।
বুধবার রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ে স্কুল অব লাইসিয়ামে গিয়ে দেখা যায়, একটি ফ্ল্যাট বাড়ির দ্বিতীয়তলায় ছোট তিনটি রুমে প্রি-প্লে থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল শাখার কোনো ধরনের অনুমোদন নেই। পাশের একটি স্কুল থেকে জেএসসি ও এসএসসির রেজিস্ট্রেশন করানো হয়ে থাকে।
২০১৪ সালে গড়ে তোলা এ স্কুলে পাঁচজন শিক্ষক আছে। স্কুলের সামনে নার্সারি শ্রেণির এক ছাত্রের অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। নাম প্রকাশ না করে ওই অভিভাবক বলেন, ৬ হাজার টাকা দিয়ে তিনি তার ছেলেকে ভর্তি করিয়েছেন। স্কুল থেকে বই-খাতা ও ড্রেস, ডায়েরি সবই কিনতে হয়। এ নিয়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। স্কুলটি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে হওয়ার কথা বলে জানান ওই অভিভাবক।
স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্কুলটি গড়ে তুলেছেন তিনি। ফ্ল্যাটের জায়গা কম হওয়ায় কিছুটা সমস্যা আছে। তবে যত্নসহকারে শিক্ষকরা পড়ান। মিরপুরের অন্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শিক্ষার্থীরা স্বল্প ব্যয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি বোর্ডের বাইরে কোনো বই পড়ানো হয় না। তবে প্রি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা-ইংরেজি সহায়ক ও ব্যাকরণ, ড্রয়িং, ধর্মশিক্ষা বই পড়ানো হয়ে থাকে।
বাড়তি বইয়ের জন্য জনপ্রতি ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা নেওয়া হয়ে থাকে। পরে মিরপুর, আজিমপুর, বকশিবাজার, মালিবাগের আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে একই চিত্র দেখা গেছে। এগুলোর একটি উত্তর পীরেরবাগের জাহানার প্রি-ক্যাডেট স্কুল। প্রতিষ্ঠানটি প্লে-গ্রুপ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করে। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তিতে ৩ হাজার টাকা আর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৫ হাজার টাকা ভর্তিতে নেওয়া হয়ে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানটিও সরকারি বোর্ডের বাইরে বিভিন্ন বই কিনতে বাধ্য করছে বলে অভিযোগ আছে। যদিও এর প্রতিষ্ঠাতা ফারুক হোসেন দাবি করেন, এলাকার ছেলেমেয়েরা অল্প ব্যয়ে পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কেজি স্কুলেও একইভাবে ভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ নিচ্ছে। এছাড়া কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, এতদিন লেখাপড়ার বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফিরছে। তবে তাদের কাছ থেকে স্কুলগুলো অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে-এমন অভিযোগ সঠিক নয়।
উল্লেখ্য, জাতীয় শিক্ষানীতিতে দেশের সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে অসংখ্য নার্সারি, কেজি ও প্রিপারেটরি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। কেজি স্কুল হিসেবে পরিচিত এসব শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই ব্যক্তিমালিকানাধীন। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। তাই সেগুলো নিবন্ধনের জন্য প্রজ্ঞাপন আকারে বিধিমালা জারি করে সরকার। কিন্তু তা বর্তমানে অকার্যকর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কেজি স্কুলের মধ্যে যেগুলো মাধ্যমিকের পাঠদান করে সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে হওয়ার কথা। সেখানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) ভর্তি সংক্রান্ত নীতিমালা প্রযোজ্য। স্কুলের এই পরিস্থিতির প্রতি সংস্থাটির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক বেলাল হোসাইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বলেন, মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠদান করে এমন প্রতিষ্ঠানকে কোনো না কোনো শিক্ষা বোর্ড থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। আর এ ধরনের স্কুলকে অবশ্যই সরকারি নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সব ধরনের অর্থ আদায় রসিদের মাধ্যমে করতে হবে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে বা ভর্তিতে নীতিমালা লঙ্ঘন করে তাহলে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকা শহরের জন্য ১৬টি তদারকি কমিটি গঠন করা আছে। তারাও বিষয়টি দেখবে। তবে এ ব্যাপারে অভিভাবকরা অভিযোগ দিয়ে সহায়তা করতে পারে।