বিশ্ব শিক্ষক দিবস
॥ অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভূঁইয়া ॥
৫ অক্টোবর’ ২০২১ইং ২৭ তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শিক্ষার অগ্রগতি, মানবজাতির ক্রমোন্নতি এবং আধুনিক সমাজের বিকাশ সাধনে শিক্ষক সমাজের অপরিহার্য ভূমিকা ও অবদানের কথা জোরের সাথে ঘোষণা করে শিক্ষকগণ যাতে এসব ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষকদের মর্যাদা সম্পর্কে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বিশেষ আন্ত: সরকার সম্মেলন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল ‘ইউনেস্কো/আইএলও সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত দিবসটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবস বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যে একটি গভীর দুঃখজনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে। করোনায় বিপর্যস্ত দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। করোনা মহামারিতে অনেক শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মারা গিয়েছেন। তাছাড়া দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষকতার পেশা অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন। অনেক শিক্ষক আর্থিক দূরাবস্থায় পড়ে ভ্যান চালক, রিক্সা চালক, সবজি বিক্রেতা ও ডে লেবারের কাজ করে জীবিকা চালিয়েছেন। অনেক কিন্ডার গার্টেন বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। অভাবের তাড়নায় আত্মহত্যার মত ঘটনা আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানতে পেরেছি। শিক্ষার এই বেহাল অবস্থায় আমরা পালন করছি বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড হলে শিক্ষকরা শিক্ষার মেরুদন্ড। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজ অবহেলিত ও বিভিন্নভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা, আর্থিক স্বচ্ছতা, সামাজিক মর্যাদা নেই বলে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে চান না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষকরা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হয়ে চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নেই বলেই আজ শিক্ষার বেহাল অবস্থা। পরিকল্পনাবিহীন শিক্ষার অভাবে অনেক কম মেধাবী এমনকি মেধাহীন ছাত্র-ছাত্রীরাও পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে সমাজে উপহাসের পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছেন। জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দেখলে অনেকেই মুচকি হাসে। এক্ষেত্রে প্রকৃত জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি অবিচার হচ্ছে বলে আমরা মনে করি।
শিক্ষাক্ষেত্রে আজ পর্বতসম বৈষম্য বিদ্যমান। সরকারী বেসরকারী স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষক-কর্মচারীদের সমযোগ্যতা ও সমঅভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও সরকারী স্কুল ও বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেলে পার্থক্য রয়েছে। সরকারি স্কুল-কলেজের ছাত্রদের যে সিলেবাস বেসরকারী স্কুল-কলেজের ছাত্রদেরও একই সিলেবাসে পড়ানো হয়। কিন্তু তাদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা ও বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়। আমাদের বেসরকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলের ২৫% ও কর্মচারীদের ৫০% উৎসব ভাতা দেওয়া হয়। বেসরকারী স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের সাথে ইহা বিমাতাসুলভ আচরণের বর্হিপ্রকাশ।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের ১/১/১৯৮০ থেকে জাতীয় বেতনের স্কেলের অন্তর্ভূক্ত করেন এবং ৫০% বেতন স্কেল প্রদান করেন। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ ১০%+১০%=২০% প্রদান করেন। ১৯৯৪ সালের শিক্ষক আন্দোলনে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১০%, ২০০০ সনে আন্দোলনে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০% সর্বশেষ ২০০৬ সনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১০% বেতন প্রদান করে ১০০% এ উন্নীত করেন। এখন চাকুরী জাতীয়করণের কোন বিকল্প নেই। চাকুরী জাতীয়করণের জন্য সরকারের অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন নেই।
শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করণের জন্য সরকারকে প্রদান করতে হবে:
বেতন বাবদ ১৪৪০০ কোটি টাকা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে গড় হিসাবে ৭০ কোটি টাকা প্রায়, ৪৬৩৯০৭ জন (সর্বশেষ পরিসংখ্যাণে অনুযায়ী), শিক্ষক-কর্মচারীর চিকিৎসা ভাতা সর্বশেষ পরিসংখ্যানে ৫৫০ কোটি টাকা প্রায়, বাড়ী ভাড়া গড় হিসাবে ৪০০০ কোটি টাকা প্রায়, ২টি উৎসব ভাতা ১২০০ কোটি টাকা প্রায়, মোট ২০২২০ কোটি টাকা প্রায়।
প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে :
১। ছাত্র-ছাত্রী বেতন; ১ কোটি ৫০ লক্ষ ছাত্র থেকে মাসে ৩০ টাকা হিসাবে বৎসরে ৪৫০ কোটি টাকা। ২। সেশন চার্জ : গড়ে প্রতি ছাত্র ১৫০০ টাকা হিসাবে ২২৫০ কোটি টাকা। ৩। প্রতিষ্ঠানের সম্পদ থেকে বাৎসরিক আয় (যেমন গাছ বিক্রি, দোকান ভাড়া, পুকুর-জমি লীজ, মাঠ ভাড়া ইত্যাদি) ৯০০ কোটি টাকা। ৪। সাধারণ তহবিল থেকে আয় কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা। ৫। রিজার্ভ ফান্ড থেকে আয় ৩০০ কোটি টাকা। ৬। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে ফান্ডের রক্ষিত টাকা থেকে আয় হবে কমপক্ষে ১৫০০ কোটি টাকা। মোট-৫৯০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে ১০০% বেতন পান। এ জন্য সরকারকে প্রদান করতে হয় প্রতিমাসে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা মাত্র। ১২ মাসে সরকারকে দিতে হয় প্রায় ১৪৪০০ কোটি টাকা মাত্র। প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে সরকারকে প্রদান করতে হবে মোট ব্যয় ২০ হাজার ২২০ কোটি টাকা প্রায়। বর্তমান সরকার বেতন বাবদ প্রদান করছে ১৪৪০০ কোটি টাকা। অতিরিক্ত প্রদান করতে হবে (২০২২০-১৪০০) প্রায় ৫৮২০ কোটি টাকা (৫৯০০-৫৮২০) ৮০ কোটি টাকা প্রায়।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীরা যে হারে নির্যাতিত হচ্ছেন এবং চাকুরী হারাচ্ছেন তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। রাজনৈতিক দলের লোকেরা অর্থের বিনিময়ে বেসরকারী স্কুল কলেজ ও মাদ্রাসায় অযোগ্য ব্যক্তিদের চাকুরী দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করণ করতে হবে।
শিক্ষকগণ হচ্ছেন জাতির বিবেক ও মূল্যবোধ সংরক্ষণের ধারক ও বাহক। শিক্ষার সংস্কার, সম্প্রসারণ ও মান উন্নয়নে সরকার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিবেন বলে শিক্ষক সমাজ প্রত্যাশা করে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সরকারের পক্ষ থেকে কোন গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী না নেয়ায় শিক্ষক সমাজ আশাহত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করি ভবিষ্যতে সরকার এ বিষয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে শিক্ষক সমাজকে যথাযথ সম্মান দেখাবে।
লেখক-চেয়ারম্যান, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট।