বিনামূল্যে লালমাই পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ‘জাপানি স্কুল’
কুমিল্লাঃ জাপানি স্কুলে পড়ালেখার জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না শিক্ষার্থীদের। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করা হয় স্কুলটিতে। প্রতি শ্রেণিতে ২০ জন করে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। সবার জন্য রয়েছে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা।
স্কুল থেকে শিশুদের জন্য জামাকাপড়, ক্রীড়া সরঞ্জাম, বই ও শিক্ষা উপকরণ বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। মেনে চলা হয় পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি। এখানে যারা পড়তে আসে তাদের কারও মা নেই, কারও বাবা নেই।
২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা হয় মজুমদার ওয়ান ড্রপ প্রাইমারি স্কুল। স্থানীয়রা স্কুলটিকে 'জাপানি স্কুল' নামে চেনেন। স্থানীয়দের কাছে স্কুলটি জাপানি স্কুল হিসেবে পরিচিত। স্কুলের প্রধান ফটকের মাথায় বাংলাদেশ ও জাপানের জাতীয় পতাকা উড়তে দেখা যায়।
স্কুলটিতে মোট ৭ জন শিক্ষক রয়েছেন, যাদের সবাই নারী। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা স্কুল কর্তৃপক্ষই বহন করে থাকে।
কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার বড় ধর্মপুর এলাকায় স্কুলটির অবস্থান। লালমাই পাহাড়বেষ্টিত এলাকাটি সাত বছর আগেও জঙ্গলে ঘেরা ছিল। যোগাযোগের জন্য রাস্তা ছিল না। পাহাড়ি পথ ধরেই যাতায়াত করতেন এ এলাকার মানুষ। সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে দিনের বেলায়ও সেখানে চলাচল করতে গা শিউরে উঠত। আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকায় ছিল না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
তাই পাহাড়ি জনপদের শিশুরা ছিল শিক্ষাবঞ্চিত। এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠার কিছু সময় পর ওই এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। কুমিল্লা-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কের রতনপুর থেকে সোজা একটি পাকা রাস্তা গেছে বড় ধর্মপুর এলাকায়।
মনোরম পরিবেশে, সবুজ পাহাড়ের বুকে ৩ তলা ভবনে পাঠদান হয় জাপানি স্কুলে। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে নজর কাড়া ইউনিফর্ম। ছেলেদের জন্য সাদা শার্টের বুকে একটি লাল সূর্য আর সবুজ রঙের ফুলপ্যান্ট। মেয়েদের জন্য সাদা জামা, লাল স্কার্ফ আর সবুজ পাজামা।
স্কুল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ইউনিফর্মটিতে জাপান এবং বাংলাদেশের প্রতীক তুলে ধরা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের খাবার রান্নার জন্য দুজন বাবুর্চি রয়েছেন। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে তারা ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের তরকারি রান্না করে গরম ভাতের সাথে পরিবেশন করেন শিক্ষার্থীদের।
স্কুলের ৪০ ভাগ ব্যয় বহন করেন তারিক উল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রী নাহিদা আক্তার। বাকিটা তাদের জাপানি বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক তোশিকো অনিশিসহ তার বন্ধুরা বহন করেন।
৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী সুরাইয়া আক্তার বলেন, আমার বাবা-মা দুজনেই দিনমজুর। এখানে স্কুল না থাকায়, আমার বড় ভাই বোনেরা লেখা পড়ার সুযোগ পায়নি। স্কুল হওয়াতে আমার লেখাপড়া করার সুযোগ হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক লাভলী আক্তার বলেন, প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আমি স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। পাহাড়ের বুকে এখানে মানুষ চলাচল করতে ভয় পেতো, সাপ-বিচ্ছুর জন্য। স্কুল হওয়াতে মানুষের পদচারণা বেড়েছে। পাহাড়ি এসব শিশুদের মধ্যে অনেক মেধাবী ছেলে-মেয়ে আছে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠার পর আমাদের অনেক শিক্ষার্থী ভালো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, এটা আমাদের জন্য গর্বের। এখন প্রচুর ছেলে-মেয়ে ভর্তি হতে আসে, কিন্তু জাপানিজরা আসন সংখ্যা সীমিত করে দিয়েছে। প্রতি শ্রেণির জন্য ২০জন শিক্ষার্থী থাকবে। এর বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি করার অনুমতি নেই, না হলে আরও প্রচুর ছেলে মেয়ে ভর্তি হতো।
জাপানি স্কুল প্রতিষ্ঠার গল্প শুনালেন তারিকুল ইসলাম মজুমদার। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে তার কিছু জাপানি বন্ধু কুমিল্লায় বেড়াতে আসেন। তাদের মধ্যে তোশিকো অনিশি অন্যতম। কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে ভিক্ষুকদের দেখে তাদের আলাদা দরদ তৈরি হয় এবং তারা সেসব ভিক্ষুকদের দান করতে থাকেন। এবং দানের পরিমাণটা খুবই বড় ছিল। তখন আমার স্ত্রী আমাকে বলেন, তারা (জাপানিরা) এভাবে টাকাগুলো না দিয়ে তাদের দিয়ে স্থায়ী কিছু করানো যায় কি না।
তিনি বলেন, এরপর মাথায় আসে আমার গ্রামের এলাকাটি পাহাড়ি এলাকা, কোনো স্কুল নেই। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে না। এখানে একটি স্কুল হলে সবচেয়ে ভালো হয়। আমি আমার প্রস্তাবটি তাদের জানাই। এরপর তারা জাপান ফিরে যান। এর কিছুদিন পর তারা আমাকে জাপান যেতে বলেন। সাথে স্কুল করার যাবতীয় পরিকল্পনা এবং বাজেটের ধারণা নিয়ে যেতে বলেন। তখন তিনতলা ভবন নির্মাণের প্ল্যান এবং খরচ নিয়ে জাপান যাই। তারা আমাকে মিটিং করে আলোচনার মাধ্যমে বরাদ্দ দেন। তারপরই স্কুলটি নির্মাণ করা হয়।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়