বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষায় SWOT Analysis
।। গাজী মোঃ আব্দুর রসিদ।।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ব্যাবস্থায় একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আর সেই গতানুগতিক চিন্তাধারার মধ্যে নেই।
একটি লম্বা সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিক্ষার্থীদের মানসিক পরিবর্তন, অভিভাবকদের মানসিক অবস্থার পেক্ষাপটে বলা যায় যে,পরিস্থিতি স্বাপেক্ষে পরবর্তীতে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলেও হয়তো আগের মত আর শিক্ষাদান প্রক্রিয়া সম্ভবপর হবে না। করোনার প্রভাবে পরিবর্তিত এই শিক্ষা ব্যবস্থাকে আমরা যদি সট এনালাইসিস (SWOT Analysis-S = Strength, W = Weakness, O = Opportunity, T = Threat ) ) প্রক্রিয়ায় মূল্যায়ন করি তবে এর মুল প্রেক্ষাপট/বাস্তবতা হলো-
১. শক্তি/সবল দিক (Strength): আমরা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোন ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পরতে দেইনি। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে বিকল্প উপায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া হচ্ছ্।ে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়েছে।
সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে এ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিভিত্তিক মূলায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাঠপর্যায় থেকে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষার তথ্য সংগ্রহ করে কিভাবে আরও কার্যকরী উপায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে বিচার বিশ্লেষণ চলছে প্রতিনিয়ত।
শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য অংশীজনদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে মানসিক শক্তি ঠিক রেখে শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখানে আমাদের শক্তিটা হলো আমাদের মানসিক দৃঢ়তা, আমাদের ধৈর্য্য, আমাদের বিকল্প চিন্তা করার প্রজ্ঞা, অভিনব সৃজনশীলতা।
২. দুর্বলতা/দুর্বল দিক Weakness): পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের দুর্বলতাগুলোর মধ্যে রয়েছে-আমরা সকল শিক্ষার্থীকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারিনি, সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে রেকর্ডকৃত শ্রেণিকার্যক্রম দেশের শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশের সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ সিলেবাসের বিষয়গুলোকে পুরোপুরি শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানো যায়নি। দীর্ঘসময় শ্ক্ষিাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকার কারণে এটা হয়েছে।
কারিকুলামের সাথে সম্পৃক্ত শ্রেণিভিত্তিক ধারণাসমূহকে শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি আয়ত্ত¡ করতে পারেনি। শিক্ষকদের পেডাগজি জ্ঞানের শ্রেণিভিত্তিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
৩. সুযোগ/সম্ভাবনা (Opportunity): করোনকালীন এই পরিস্থিতি আমাদের শিক্ষায় ব্যাপক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব আমাদের শিখিয়েছে কিভাবে শ্রেণিকার্যক্রমের বাইরে থেকেও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে অনলাইন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখা যায, শিক্ষায় আইসিটি জ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, শিক্ষা সংক্রান্ত নতুন নতুন ধারণাসমূহের সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পরিচিত হবার সুযোগ পেয়েছে, দূরশিক্ষণের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করে কিভাবে আরোও সহজতর প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাকে পৌঁছানো যায় সেই কৌশল শিখিয়েছে, শিক্ষকদের আধুনিক এবং আইসিটিসমৃদ্ধ পেডাগজিজ্ঞানে আরও ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হবার সুযোগ করে দিয়েছে। আধুনিক, বাস্তবতানির্ভর এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি কারিগরীজ্ঞানসমৃদ্ধ কারিকুলাম প্রণয়নে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে, আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি বাস্তবসম্মত সেতুবন্ধন তৈরিতে সহায়তা করেছে।
৪. ঝুঁকি/চ্যালেঞ্জ (Threat): শিক্ষক-শ্ক্ষিার্থীদের অনলাইনভিত্তিক আইসিটিজ্ঞানে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করতে না পারলে, এই ধারার সাথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের সহজতর প্রক্রিয়ায় খাপ খাওযাতে না পারলে শিক্ষা ব্যবস্থায় ঝড়েপরার হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে প্রতিনিয়ত পরিদর্শনের প্রেক্ষিতে দেখা যাচ্ছে যে, করোনাকালীন এই সময়ে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হবার কারণেও শিক্ষায় ঝড়েপরার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি শিক্ষার্থীকে অনলাইন শিক্ষার আওতায় একই প্ল্যাটফর্মে এনে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা বাস্তবিক অর্থে সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জ।
তবে আশার কথা হলো সরকার এই লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যে সকল ডিভাইস ব্যবহার করে সেগুলোর অপব্যবহার হবার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য শিক্ষক বিশেষ করে অভিভাবকদের সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের উপর অভিভাবকদের অবশ্যই প্রতিনিয়ত মনিটরিং করতে হবে।
পরিবর্তিত এই বাস্তবতায় শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার জরুরী হয়ে পরেছে। শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে আমাদের শিক্ষার্থীদের আবশ্যিকভাবে আইসিটিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হবে। অনলাইন শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের স্বার্থে শিক্ষকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে হবে। দূরশিক্ষণের উপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বল্পমুল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে কিংবা সহজ কিস্তিতে মোবাইল সেট, ল্যাপটপ, ট্যাব, ইন্টারনেট বিল ইত্যাদি প্রদান করা যেতে পারে।
লেখক-
রিসার্চ অফিসার, জেলা শিক্ষা অফিস (মাধ্যমিক), মুন্সীগঞ্জ।