বন্ধের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে
নিউজ ডেস্ক।।
ব্যবসাবাণিজ্য ও বিনিয়োগে ই-কমার্স অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিতে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছে ই-কমার্স খাত। বিশেষ করে করোনা মহামারীর মধ্যে মানুষ ঘরবন্দি থাকায় এই খাত বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের কারণে মøান হয়ে যায় স্বপ্ন দেখানো ই-কমার্সের অনেক অর্জন। কোটি কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসেছেন হাজারো গ্রাহক। অনেকেই হন সর্বস্বান্ত। ফলে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সব গ্রাহক এখনো টাকা ফেরত পাননি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে ৬টি কোম্পানি এবং ১টি ফেসবুক পেজ বন্ধ করা হয়েছে। শিগগির আরও ১০-১২টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে যাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খল ফেরাতে সরকার কাজ করছে। গ্রাহক স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে আড়াই শ কোটি টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি টাকাও পর্যায়ক্রমে ফেরত দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ৬টি প্রতিষ্ঠান এবং ১টি ফেসবুক পেজের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। আরও কয়েকটির বিষয়ে টেকনিক্যাল কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০ জুনের পর লেনদেন পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানে (পেমেন্ট গেটওয়ে) ২৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের মোট অর্থ আটকে ছিল ৫২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৮২ কোটি ৪১ লাখ টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছে। নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ২০ হাজার ২৯৯ জন। তবে গ্রাহকরা আস্তে আস্তে টাকা ফেরত পাবেন বলে আশাবাদী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দিলেও বাকি ১৪টি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেনি।
জানা গেছে, বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির বড় প্রতারণার কারণে দেশের ই-কমার্স খাতের দুর্নীতি নিয়ে টনক নড়ে মানুষের। এরপর একে একে অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আলেশা মার্ট, ধামাকাসহ প্রায় অর্ধশত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ফলে শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে সরকারের নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টদের মতে, লোভনীয় অফার দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে হাতিয়ে নেয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন আমাদের সময়কে বলেন, ই-কমার্সে আস্থা ফেরাতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। ইতোমধ্যে ১৬টির সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। নতুন সদস্য করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। ভোক্তাদের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। আইন সংশোধনেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে নানা ধরনের সভা, সেমিনার করা হচ্ছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত ৪৬টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে অর্থ ফেরত চেয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে ২৭ হাজার ৭৮৩টি। তার মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক বা ৪৬ দশমিক ২৮ শতাংশ। অনিষ্পন্ন অভিযোগের সংখ্যা ১৪ হাজার ৯২৪টি।
কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে জমা পড়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। মোট অভিযোগের সংখ্যা ১০ হাজার ৭৫৫টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়া অভিযোগের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৯৫টি। অনিষ্পন্ন অভিযোগ ৬ হাজার ২৬০টি। নিষ্পত্তির হার ৪১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এর পরেই এসেছে আরেকটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের নাম। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অধিদপ্তরে অভিযোগ পড়ে ৫ হাজার ৮৭১টি। অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩টি। অনিষ্পন্ন অভিযোগের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৩৮টি। অভিযোগ নিষ্পত্তির হার শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ।
তৃতীয় অবস্থানে থাকা দারাজ ডটকমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১ হাজার ৭০টি, যার ৯০ দশমিক ৩৭ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে। অনিষ্পন্ন অভিযোগ ১০৩টি। এ ছাড়া ফাল্গুনি ডটকমের বিরুদ্ধে আসা ৬৬৮টি অভিযোগের মধ্যে ৫৯৮টি, প্রিয়শপের বিরুদ্ধে ৬৫৪টি অভিযোগের বিপরীতে ৪৬৮টি নিষ্পত্তি হয়েছে। ধামাকা শপিংয়ের ৫৫৭টি অভিযোগের বিপরীতে নিষ্পত্তি মাত্র ৮১টি। কিউকমের বিরুদ্ধে ৩৬৭টি অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে সাতটি।
ফুড পান্ডার বিরুদ্ধে ৩৪০টি অভিযোগের বিপরীতে নিষ্পত্তি ২৬১টি। আলেশা মার্টের বিরুদ্ধে ৩১৮টি অভিযোগ করেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি মাত্র তিনটি। এ ছাড়া পাঠাওয়ের বিরুদ্ধে ২৭০টি অভিযোগের বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬৬টি, চালডালের বিরুদ্ধে ২০৬টি অভিযোগের মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৭৯টি। অথবা ডটকমের ২০১টি অভিযোগের বিপরীতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬২টি। আজকের ডিল ডটকমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১৮৪টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬৯টি। বিক্রয় ডটকমের বিরুদ্ধে গ্রাহকের অভিযোগ ১৭৬টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬০টি। আদিয়ান মার্টে গ্রাহকের অভিযোগ ১৫৮টি, নিষ্পত্তি মাত্র ৩৯টি। উবারের বিরুদ্ধে ১৩০টি অভিযোগ করেছেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি ১২৬টি। নিরাপদ ডটকমে গ্রাহকের অভিযোগ ১১৯টি, নিষ্পত্তি মাত্র ৭৩টি। দালাল প্লাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১০১টি। নিষ্পত্তি মাত্র সাতটি।
আলোচ্য সময়ে ফেসবুক পেজগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহকরা ৫ হাজার ২২৭টি অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর নিষ্পত্তি করেছে ৪ হাজার ৬০৬টি অভিযোগ। নিষ্পত্তির হার ৮৮ দশমিক ১২ শতাংশ।