ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা
কায়সুল খান।।
আধুনিক পৃথিবীতে শিক্ষায় সাফল্যের প্রশ্নে এক বিস্ময়ের নাম ফিনল্যান্ড। মাত্র ৫৫ লাখের কিছু বেশি জনসংখ্যাবহুল উত্তর ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা। আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে ফিনিশরা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনে। বিগত দুই দশক ধরে তারা সেই পরিবর্তনের ফল লাভ করছে। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে শিক্ষার হার ৯৯ শতাংশ। পৃথিবীর বহুল প্রচলিত প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে ফিনিশরা গড়ে তুলেছে সহযোগিতামূলক পরিবেশে আনন্দদায়ক শিক্ষণ পদ্ধতি। ফিনিশ শিক্ষার্থীরা ফলনির্ভর পড়াশোনার বদলে আত্ম-উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষালাভ করে থাকে। ফলশ্রুতিতে তাদের দক্ষতা ও কর্মস্পৃহা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি বলে দৃশ্যমান।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাধ্যমিক সমাপনী বা ন্যাশনাল ম্যাট্রিকুলেশন এপাম ভিন্ন কোনো কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেই। এখানে নিজ নিজ স্কুলের শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করে থাকেন। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হয় কেননা ফিনিশরা মনে করে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই আইডেন্টিক্যাল এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো শাস্তিমূলক পরিবেশের বদলে ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোতে একটি আনন্দদায়ক শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমগ্র দেশে শিক্ষার সমান সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি নিশ্চিত করে। তাই ফিনল্যান্ডের স্কুলগুলোর মধ্যে পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে কোনো প্রতিযোগিতার সুযোগ নেই। রবং সব স্কুলই শিক্ষার্থীদের আত্মিক উন্নতি ও দক্ষতা বৃদ্ধিকরণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ছয় বছর বয়স থেকে শুরু হলেও ফিনল্যান্ড এর ব্যতিক্রম। ফিনল্যান্ডে সাত বছর বয়স হলে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে এক বছর ঐচ্ছিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। তারা মনে করে, অল্প বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ অপেক্ষা শিশুদের পরিবার ও সমবয়সীদের সঙ্গে সামাজিকীকরণ অধিক জরুরি ও ফলপ্রসূ। ১৮৯০ সালে ফিনিশরা শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কারে কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফিনল্যান্ডে মনে করা হয়, শিক্ষা হলো সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের একটি হাতিয়ার। ফিনল্যান্ডে সব শিক্ষার্থীকে স্কুলে দুপুরের খাবার প্রদান করা হয়। তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া হয় এবং প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেখভাল করা হয়। শিক্ষার্থীরা খুব ভোরে ঘুম ঘুম চোখে স্কুলে যেতে হয় না বরং তারা একটু সময় নিয়ে ক্লাস শুরু করে। যে কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত করে ক্লাসে আসতে পারে। একই সঙ্গে প্রতি এক ঘণ্টায় ৪৫ মিনিট পড়াশোনা করলে এখানকার শিক্ষার্থীরা ১৫ মিনিট করে বিরতি পায়। ফলে তারা উৎফুল্ল চিত্তে পরবর্তী ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে। একই সঙ্গে ফিনল্যান্ড শিক্ষার্থীদের যথাসম্ভব কম বাড়ির কাজ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। স্কুল পর্যায়ে গড়ে একজন শিক্ষার্থী দিনে মাত্র ৩০ মিনিট বাড়িতে একাডেমিক পড়ালেখা করে। ক্লাসের আকৃতিও অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট। তাছাড়া সাধারণত ফিনল্যান্ডে একজন শিক্ষার্থী স্কুলিংয়ের প্রথম ছয় বছর একজন শিক্ষকের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকে। ফলে ওই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে একটি বন্ধন গড়ে ওঠে এবং শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীর শক্তি ও দুর্বলতাগুলো বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাদান করা সম্ভব হয়।
ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় সাত থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত ৯ বছরের কম্প্রিহেনসিভ শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক শিক্ষার এই পর্যায়ে ফিনিশ শিক্ষার্থীরা ভাষা, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, সংগীত, চিত্রকলার ওপর শিক্ষালাভ করে। মাতৃ ভাষার পাশাপাশি ফিনিশদের আরও দুই বা ততোধিক ভাষা শিখতে হয়। ফলে একজন ফিনিশ শিক্ষার্থী গড়ে তিন থেকে চারটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় ১৭-১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষালাভ করে। এই স্তরে পড়াশোনা করাও এক প্রকার বাধ্যমতামূলক। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে দুটি ভাগ রয়েছে। ট্রেডিশনাল ও ভোকেশনাল। সাধারণত খুব ভালো শিক্ষার্থী যারা পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী তারা ট্রেডিশনাল উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে ভর্তি হয়। অন্যদিকে যারা দ্রুত কর্মসংস্থানের প্রতি আগ্রহী তারা ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। সাধারণত ৮৩% শিক্ষার্থী ভোকেশনাল শিক্ষায় যায়। ফিনল্যান্ডে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের জন্য কোনো বেতন প্রদান করতে হয় না বরং রাষ্ট্র নাগরিকদের দক্ষ করে তোলায় প্রয়াসে শিক্ষা ক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ করে। ট্রেডিশনাল শিক্ষায় যারা ভর্তি হয় তারা ভাষা, উচ্চতর গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীব বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে দক্ষ হয়ে ওঠে।
১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা বিনামূল্য ছিল। বর্তমানে ইইউ বা ইইএর বাইরের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার স্তরে ফিনল্যান্ড টিউশন ফি ধার্য করেছে। ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাওয়া কঠিন। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক স্তরের মূল্যায়নের ফলাফল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এন্ট্রান্স এপামের সমন্বিত ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ মেলে। ট্রেডিশনাল উচ্চশিক্ষায় ফিনল্যান্ডে তিনটি স্তর রয়েছে। যথা- ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং ডক্টরাল। অন্যদিকে ভোকেশনাল শিক্ষায় যারা যায় তারা বিশেষ ব্যাচেলর ও মাস্টার্স সম্পন্ন করতে পারে।
ফিনল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হেলসিংকি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইস্টার্ন ফিনল্যান্ড, হেলসিংকি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, হেলসিংকি স্কুল অব ইকোনমিপ, স্যাভনিয়া ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স ফিনল্যান্ডের নামকরা আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়। ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা মূলত গবেষণামূলক। যেসব শিক্ষার্থী জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে আগ্রহী ও সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচিত হয় শুধু তারাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পায়।
ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা পেশায় আসার নূ্যনতম যোগ্যতা মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন। শিক্ষকতা পেশায় কেউ আসতে চাইলে উচ্চশিক্ষায় নিজ নিজ ক্লাসে ১০ পার্সেন্টাইলের মধ্যে স্থান করে নিতে হয়। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের উচ্চ হারে সম্মানী প্রদান করা হয়, তবুও শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের বিবেচনায় ফিনল্যান্ড বিশ্বের সেরা ১০টি দেশের মধ্যে নেই। মূলত শিক্ষক নিয়োগে জিরো টলারেন্স এবং উন্নততর শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের মাধ্যমে ফিনিশরা শিক্ষা ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় বিপল্গব ঘটিয়েছে।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফিনল্যান্ডও বোলগোনা পদ্ধতিতে পাঠদান করে থাকে। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চাইতে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক পার্থক্য হলো এখানে শিক্ষক বলেন কম, বরং শিক্ষার্থীরা পরস্পরের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে শিখে থাকে। ফলশ্রুতিতে ফিনিশরা সৃজনশীল এবং মৌলিক চিন্তা করার দক্ষতা অর্জন করে। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক দিক হলো মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি এডুকেশন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে এখানকার শিক্ষার্থীরা সামাজিকীকরণ, আত্মপ্রকাশ, সাংস্কৃতিক বিকাশ, গবেষণা ও জ্ঞান সৃষ্টির দক্ষতা অর্জন করে। বর্তমান বিশ্বে ফিনিশ শিক্ষা ব্যবস্থা একটি আদর্শ মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা পৃথিবীর নানা দেশে ফিনল্যান্ডের শিক্ষা মডেল বাস্তবায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। আমরা আশা করি, বাংলাদেশ সরকারও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে ফিনিশ মডেল অনুসরণের প্রতি আগ্রহী হবে