পরিত্যক্ত পলিথিন নিয়ে শিক্ষার্থী রোস্তমের নতুন উদ্ভাবন
কুড়িগ্রামের রাজারহাটে রোস্তম আলী নামের এক তরুণ উদ্ভাবক পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক বোতল পুড়িয়ে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও এলপি গ্যাসের মতো জ্বালানি তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। তার তৈরি করা পদ্ধতি ও জ্বালানি সরেজমিনে দেখতে প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভিড় জমাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ রাশেদুল হক প্রধানসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা রোস্তম আলীর পেট্রোল তৈরি পদ্ধতি পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলার উমরমজিদ ইউনিয়নের বালাকান্দি গ্রামের কৃষক মফিজুল হকের পুত্র রোস্তম আলী (২২) বাড়ির উঠানেই একটি আবদ্ধ তেলের ড্রামে বেশকিছু পরিত্যক্ত পলিথিন রেখে আগুনের তাপ দিয়ে পলিথিন গলিয়ে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও এলপি গ্যাস তৈরি করেন। এসব জ্বালানি তার নিজস্ব মটর সাইকেলে ব্যবহার করে এলাকার মানুষকে হতবাক করে দিয়েছে। এছাড়া মাটি ও পানিতে ওই তরল পদার্থ ফেলে দিয়ে আগুন প্রজ্বলিত করে পেট্রোল প্রমান করেছেন। তার দেয়া পেট্রোল ও অকটেন ব্যবহারকারী এলাকার বেশ কিছু মটর সাইকেল আরোহী বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তরুণ উদ্ভাবক রোস্তম আলী জানান, ছোটবেলায় শীতকালে ঠাণ্ডার হাত থেকে রক্ষা পেতে খড়কুঁটো দিয়ে বাড়িতে আগুন জ্বালানো হতো। সেখানে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতলও পোড়ানো হত। পলিথিন পোড়ালে তরল পদার্থ পড়তো। কিন্তু সেটি পরিবেশ বান্ধব ছিল না। পরে এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন রোস্তম। এই তরল পদার্থ আসলে কি, তা নিয়েই চলে গবেষনা।
এ সম্পর্কে তিনি বলেন, আড়াই বছর আগে ২০১৭ সালের দিকে একদিন টিনের ছোট কৌটায় পলিথিন পুড়ে তরল পদার্থ বের করি। সেগুলো শোধন করে পরীক্ষা করে দেখতে পাই এগুলো ডিজেল ও পেট্রোল জাতীয় তরল পদার্থ। পরে পরিকল্পনা মোতাবেক পরিত্যক্ত পলিথিন যত্রতত্র ফেলে না দিয়ে এগুলো সংগ্রহ করে একটি আবদ্ধ প্রকোষ্ট ড্রামে ভিতরে রেখে আগুনে অতিমাত্রায় তাপ প্রয়োগ করে গলিয়ে ফেলতে থাকি। বাস্পায়িত হয়ে ডিজেল এবং নল দিয়ে বের হয়ে পেট্রোল অকটেন তৈরি হয়। সর্বশেষ পাইপ দিয়ে গ্যাস বের হলে সেখানে আগুন দিলে আগুন লেগে থাকতো। যত তাপমাত্রা বেশি দেয়া হত তত বেশি তরল পদার্থ নির্গত হয়। সেই সাথে গ্যাস বের হয়। এসব সংগৃহীত তরল পদার্থ দু’টি পদ্ধতিতে পরিশোধন করা হয়। এক ছাকন পদ্ধতি, দুই থিতানো পদ্ধতি।
উদ্ভাবক রোস্তম আলী ওই এলাকার কৃষক মফিজুল হকের কনিষ্ট পুত্র। দুই ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ট রোস্তম। মাত্র ৭ শতক জমির উপর তাদের বসতবাড়ি। এছাড়া তাদের আর কোন আবাদি জমি নেই। মাত্র চার বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন রোস্তম। ছোটবেলা থেকেই গবেষনায় আগ্রহী রোস্তম ২০১৩ সালে পান্থাবাড়ি বালাকান্দি দ্বি-মূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে অভাবের কারণে ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পেরে কুড়িগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে ডিপ্লোমা পাশ করার পর অনলাইন কোর্সে ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি অনলাইনে অধ্যায়নরত।
এছাড়া সংসারের হাল ধরতে প্রাইভেট টিউটর হিসেবেও কাজ করছেন। পাশাপাশি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পরিবেশ বান্ধব পরিত্যাক্ত পলিথিন প্লাস্টিক থেকে ডিজেল, পেট্রোল এলপি গ্যাস ছাড়াও বেশ কযেকটি আর্কষনীয় গবেষণা রয়েছে তার। এর মধ্যে উছিষ্ট পলিথিনের ছাই ফটোষ্ট্যার্ট মেশিনের কালি হিসেবে ব্যবহার উপযোগী করার পদ্ধতি অন্যতম।
উদ্ভাবক রোস্তম আলী দাবি করেন, এই তরল পদার্থ গুলো হাইড্রোকার্বন এবং এগুলোর ধর্ম এবং বর্ণ ডিজেল পেট্রোল, অকটেন এবং নির্গত গ্যাস এলপি গ্যাসের মতো। তাই এগুলো ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন ও এলপি গ্যাস। তিনি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সুযোগ না পেলেও প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করেছেন।
এলাকাবাসীর ধারণা, রোস্তম আলীর তৈরি করা জ্বালানি এক সময় খনিজ সম্পদে প্রভাব ফেলে অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক হবে।
পার্শ্ববর্তী এলাকা পান্থাবাড়ী বালাকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধনেশ্বর চন্দ্র বর্ম্মণ বলেন, রোস্তম আলী আমাদের ছাত্র ছিল। আমরাই ভাবতে পারিনি, সে এতবড় আবিষ্কারক হবে। রোস্তম আলী অস্বচ্ছল পরিবারের সন্তান। তাই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরো ভাল কিছু করতে পারবে বলেও তার অভিমত।
রাজারহাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুহম্মদ রাশেদুল হক প্রধান বলেন, রোস্তম আলীর পলিথিন পুড়ে পেট্রোল তৈরির বিষয়টি দেখলাম। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। রোস্তম আলীর এই উদ্ভাবনকে আরো উন্নত মানের করতে যতটা সহযোগিতা প্রয়োজন, তা করা হবে।