“মুক্তমত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
নতুন কারিকুলাম: মুখস্থর বিপরীতে হাতে-কলমে শিক্ষা
সাধন সরকারঃ নতুন শিক্ষা কারিকুলামের ওপর উপজেলাপর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনার (মাধ্যমিকপর্যায়) হিসেবে ট্রেনিং চলাকালে কারিকুলাম-সংশ্লিষ্ট একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পরিদর্শনে এসে বলেছিলেন, খাতায় বমি করা পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে আমাদের সরতেই হবে। বাস্তবতাও সে কথা বলছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মুখস্থবিদ্যার ওপর ভর করে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময় কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, বাস্তবতার নিরিখে চলমান ও ভবিষ্যৎ কর্মচাহিদার কথা মাথায় রেখে প্রতি পাঁচ থেকে সাত বছর পরপর কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম পরিবর্তন একটা স্বাভাবিক বিষয়। কোচিংনির্ভরতা, মুখস্থ বিদ্যা আর গাইউ বইয়ের পড়ালেখা দিয়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব! আগামীর যান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সমন্বয় ঘটিয়ে তাদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, অনার্স-মাস্টার্স পাস করেও লাখ লাখ শিক্ষার্থী বেকার। তারা কাজ পাচ্ছে না। আবার বিদেশিরা আমাদের দেশে এসে তাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে লাখ লাখ ডলার কামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে কাজের ক্ষেত্র ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। দক্ষতা ব্যতীত শুধু মুখস্থ বিদ্যা কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, এটা এখন প্রমাণিত। পরীক্ষার আগে পড়া মুখস্থ বিদ্যা পরীক্ষার পরে আর মনে থাকে না। যে পড়া পরীক্ষার পর কাজে আসছে না সে পড়া পড়ে লাভ কী? শুধু সার্টিফিকেটনির্ভর পড়াশোনা বর্তমান যুগে আর কাজে আসবে না! একজন শিক্ষার্থী হৃদয় দিয়ে পড়ালেখা যদি অনুভব করতে না পারে তাহলে সে শিক্ষা কখনো স্থায়ী হয় না। আর স্থায়ী হয় না বলেই শিক্ষিত বেকার তৈরি হয়! অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, অধিকাংশ শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভর করে পরীক্ষা আর ফলাফলের প্রতি এত বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে যেন যেকোনো মূল্যে ‘এ প্লাস’ পেতেই হবে! দেখা যাচ্ছে, ধনী ঘরের ছেলেমেয়েরা ভালো ফলাফলের উদ্দেশ্যে টাকার বিনিময়ে একাধিক বিষয়ে কোচিং করার সুযোগ পেলেও অপেক্ষাকৃত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সে সুযোগ পাচ্ছে না। তাই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। নিজে শিক্ষকতা করতে গিয়ে দেখেছি, মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের প্রতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা যোগ্য সহপাঠীর মতো সম্মান করে না। ক্ষেত্রবিশেষে মানবিক সহপাঠীর নামও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা জানে না! মনে হয় যেন মানবিক বিভাগে একবারে কম মেধাবীরা পড়ে! অষ্টম শ্রেণির পরে একটা রীতি চালু ছিল শুধু টাকাওয়ালা ও তথাকথিত মেধাবীরাই যেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার উপযোগী! জীবনের শুরুতেই এই যে বৈষম্যের মধ্যে শিক্ষার্থীদের ডুবিয়ে রাখা এটা কোনোভাবেই শুভ ফল বয়ে আনে না।
শিক্ষার্থীদের পেছনে রাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে আবার সেই শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে যদি বেকার বসে থাকে তাহলে বুঝতে হবে কোথাও না কোথাও গলদ আছে। নতুন কারিকুলাম যেভাবে তৈরি করা হয়েছে, সেখানে বেকার তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষার্থীরা হাতেকলমে কাজের মাধ্যমে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ হয়ে উঠবে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের শিখন স্থায়ী হবে সন্দেহ নেই। কেননা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় মুখস্থ বিদ্যা পরীক্ষার বদলে ব্যাপকভিত্তিক হাতেকলমে কাজ ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন ছাড়া পুরো বছর ধরে শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শুধু পরীক্ষার আগের পড়ে পাস করার সুযোগ নেই। পুরো বছরব্যাপী শিক্ষার্থীকে সক্রিয় থাকতে হবে। শিক্ষার্থীদের আচরণ কাঙ্ক্ষিত, ইতিবাচক ও শিক্ষার্থীবান্ধব হচ্ছে কি না সেটার মূল্যায়নে বছরব্যাপী আচরণিক মূল্যায়নেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শুধু শ্রেণিকক্ষের ভেতরে নয়, শ্রেণিকক্ষের বাইরে ব্যাপকভিত্তিক অনুশীলনের সুযোগ রয়েছে। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে গৎবাঁধা মুখস্থবিদ্যার বদলে আনন্দদায়ক শিখন ও শিখনকে স্থায়ী ও দৃঢ় ভিত্তির রূপ দিতে শিক্ষার্থীবান্ধব সব কৌশল ও প্রক্রিয়া যুক্ত করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা ট্রাফিক সিগন্যাল মানার বিষয়গুলো নিজেরা অভিনয়ের মাধ্যমে শিখছে, গণিতের কাজগুলো তারা কাগজ কেটে কেটে করছে, বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে চারপাশ দেখার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের চারপাশ ও প্রকৃতি থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে। শিক্ষার্থী ছোট ছোট সমস্যা নির্ধারণ করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে করে সে তথ্য বিশ্লেষণ করে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে। আগে ক্ষেত্রফলের অঙ্ক খাতায় করলেও এখন চেয়ার-টেবিল বা বেঞ্চ পরিমাপ করে হাতেকলমে ক্ষেত্রফল বের করছে। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাসূচি সমাপ্ত শেষে শিক্ষাসফর বা ভ্রমণে যাচ্ছে। এলাকাভিত্তিক বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে সরাসরি কথোপকথনের সুযোগ যুক্ত করা হয়েছে নতুন কারিকুলামে। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০টি বিষয়ে এমন শিক্ষার্থীবান্ধব ও আনন্দদায়ক শিখনের সুযোগ রাখা হয়েছে, যা সময়োপযোগী ও একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান শিখনব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বইয়ের পড়ার সঙ্গে যদি জীবনের সংযোগ ঘটানো না যায় কিংবা অর্জিত বিদ্যা যদি নিজের জীবনে কোনো কাজে না আসে তাহলে সে শিক্ষার কোনো দাম থাকে না। এখন শুধু শ্রেণিকক্ষের মধ্যে শিখনব্যবস্থাকে আটকে রাখার সুযোগ নেই। সময় বদলেছে। যে প্রিন্টারে সমস্যা হলে মানুষ সার্ভিসিং করাতে নিয়ে যেত এখন ইউটিউবের ভিডিও দেখে সেটা অনায়সে মেরামত করে ফেলছে। কৃষিকাজের তথ্য, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য সম্পর্কিত তথ্য ও সমস্যার খুঁটিনাটি সমাধান এখন ইউটিউব থেকে অনায়সেই জানা যায়। যেকোনো সমস্যা পতিত হলে মানুষ আগে ইন্টারনেট বা ইউটিউব থেকে জানার চেষ্টা করছে। কাজেই পড়াশোনা এখন শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। যুগের সঙ্গে, কর্মপরিধির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কারিকুলাম পরিবর্তন হবে, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। শিক্ষা পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে আগামীতে উচ্চশিক্ষা ও চাকরি পাওয়ার পড়াশোনার ধরনেও পরিবর্তন আসবে বলে মনে করি। কোনো কোনো অভিভাবক ও মুষ্টিমেয় লোক না জেনে, না পড়ে, না বুঝে নতুন বই ও পড়ালেখার নতুন ধরন নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছেন। এটা মাথায় রাখতে হবে মুখস্থ ও পরীক্ষানির্ভর শিক্ষার্থীদের হঠাৎ মুখস্থহীন শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো একটু সময়ের ব্যাপার। অনেকে শিখন-শেখানো ব্যবস্থার এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারছেন না। নতুন সব বই না পড়ে, না জেনে, নতুন কারিকুলাম সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল না হয়ে আগেই বিভ্রান্তি ছড়ানো ঠিক নয়। নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া হয়নি! পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। নতুন শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং তার সঙ্গে আবেগ-ভালো লাগা-ভালোবাসা তৈরি করতে স্বাভাবিকভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কিছুটা সময় লাগবে। আমার মতে, চলতি বছর নতুন কারিকুলামের শতভাগ কাজ করা শিক্ষকদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি! আগামী বছর (২০২৪) থেকে সেটা আর হবে না। তা ছাড়া নতুন কারিকুলাম ২০২৩-এ বাস্তবায়ন পর্যায়ে এসে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তাই অত্যন্ত যুগোপযোগী ও বাস্তবসম্মত এই কারিকুলাম সম্পর্কে অভিভাবকদের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। নতুন এই কারিকুলাম শুধু বাংলাদেশে নয় পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে এই কারিকুলাম চালু আছে।
শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তিময় যুগ সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের তৈরি করতে হবে। নতুন নতুন কর্মপরিধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। নতুন শিক্ষাপদ্ধতিতে ছোট ছোট কিছু ভুল থাকলে শিক্ষাবিদ ও কারিকুলাম-সংশ্লিষ্টরা বসে সেটা অবশ্যই সংশোধনযোগ্য। তাই বলে ঢালাওভাবে পুরো কারিকুলাম, বই ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা ও কারিকুলাম বাতিল করার দাবি অজ্ঞতার পরিচয়। নতুন কারিকুলামে হাজারো ভালো বিষয় (মুখস্থ বিদ্যার বদলে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন, কোচিং শিক্ষা ও গাইডবই লাগবে না) আছে। সেসব শিক্ষার্থীবান্ধব ইতিবাচক বিষয় বাদ দিয়ে দু-একটি (রান্নাবান্না ও শারীরিক পরিবর্তন) বিষয় নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক অপপ্রচার করা দেশের জন্য শুধু অশুভ নয়, দেশদ্রোহীর শামিল।
লেখক : শিক্ষক ও নতুন কারিকুলামে উপজেলা পর্যায়ে মাস্টার ট্রেইনার
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১১/১২/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়