নজরুলের ধর্মীয় চিন্তা
ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন।।
বাংলাদেশ স¤প্রীতির দেশ। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য, স¤প্রীতি ও বন্ধুত্বের বন্ধন খুব নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। পারলৌকিকতার চেয়েও অধিক মূল্যবান ধর্মীয় উৎসবের দায়বদ্ধতা। প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে থাকে মানবিক উপাদান, আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক চেতনা। বাঙ্গালি উৎসব মুখর একটি জাতি। সব ধরনের উৎসবে খুঁজে পায় সৃষ্টির রহস্য এবং আনন্দ। সেই অর্থে ইসলামের সকল বুনিয়াদকে সঠিকভাবে পালনেও সহজ সরল বাঙ্গালি মুসলমান পিছিয়ে নাই। কবি তাই মানুষের আবেগ অনুভুতির বিষয়টিকে যতœকরে তুলে ধরেছেন তাঁর লেখনিতে। মূলত. কবি নজরুলের ধর্মীয় সেই বিশ্বাসকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই।
বাঙালি মুসলমানদের চেতনার জাগরণের কথা ভাবলেই নজরুল রচিত ইসলামী গান গুলো আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে ধরা দেয় এবং বাস্তবতাও তাই। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন অন্ধকারে ঠিক তখনই নজরুল জিমিয়ে পড়া মুসলিম সমাজকে জাগিয়ে তোলেন। আমরা নি.সন্দেহে এই কথা বলতে পারি যে, বাংলা কাব্য সঙ্গিতের ধারায় নজরুল ইসলাম ইসলামী সঙিতের ধারাটি সূচীত করেন। বিষয় ও সঙ্গিত বৈচিত্র বলতে যা বুঝায় নজরুল তারও ধারাবাহিকতা এখানে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলা ইসলামী সঙ্গিতের যে ধারা নজরুল প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাকে এখনও কেউ উতরিয়ে যেতে পারেননি। এককথায় বলতে গেলে নজরুল বাংলা সঙ্গিতের ধারায় এক ধরনের বিপ্লব সৃষ্ঠি করেছিলেন, এক্ষেত্রে নজরুল তার বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, সফলও হয়েছেন। আমার আলোচনা নজরুলের সঙ্গিত নয় বরং তার ইসলামী চিন্তা নিয়েই আলোচনা করতে চাই।
হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) আল্লার হাবিব, তাঁর প্রিয় বান্দা, যাঁর কাছে আল্লাহ জিব্রাইলের মাধ্যমে পবিত্র কোরআন নাযিল করেছেন। শুধু কোরআন নাযিল করেছেন, মুহাম্মদ (স.) কে ভালবেছেন তা নয়, তাঁর মাধ্যমে তিনি ইসলাম প্রচারও করেছেন। মুহাম্মদ (স.) কে এত বেশি ভালবেসেছেন যে, আল্লাহ কখনও প্রিয় মুহাম্মদ (স.) কে নাম ধরেও ডাকেননি। নানা উপাধিতে তাঁকে ডেকেছেন, তাঁকে সম্বোধন করেছেন নানা নামে ও নানা শব্দে। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম তাঁর রচিত ইসলামী সঙ্গিতে একই কন্ঠে আল্লাহ ও রসূলের গুণ কীর্তন করেছেন। কবির ভাষায়,
‘আল্লাহকে যে পাইতে চায় হযরতকে ভালবেসে
আরশকুর্শী লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।’
নজরুল তাঁর বিখ্যাত এই লেখনির মাধ্যমে আল্লার দিদার লাভের উপায় অত্যন্ত সুনিপুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আল্লাহকে পাওয়ার সহজ উপায় হিসাবে রসূলকে ভালবাসার কথা বার বার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আবার আরেকটি লেখায় তিনি এমনভাবে বলেছেন,
‘আল্লা ব’লে কাঁদ বারেক রসূল বলে কাঁদ
সাফ হবে তোর মনের আকাশ উঠবে ঈদের চাঁদ।’
নজরুল ইসলাম উল্লেখিত লেখায় মানুষকে আল্লার জিকির, আল্লার প্রতি একনিষ্ট ভক্তি, আতœত্যাগ, পৃথিবীর অতিরিক্ত মোহে জড়িয়ে নিজেকে উৎসর্গ করা হতে বিরত থেকে আল্লা ও রসূলের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনের কথাও বলেছেন। আর যিনি এই কাজটি করতে পারবেন তাঁকে প্রকৃষ্ট ঈমানদার হিসাবে নজরুল আখ্যায়িত করেছেন এবং তাঁর জন্য ঈদের চাঁদ দেখার আনন্দের মত আতœহারা আণন্দ পাবে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। যিনি আল্লাহ ও তাঁ প্রিয় বান্দা রসূল মুহাম্মদ (স.) এর তরিকা অনুযায়ী চলবেন তাঁকে প্রকৃত ঈমানদার হিসাবে নজরুল আখ্যা দিয়েছেন।
ইসলামের ৫টি বুনিয়াদ বা রোকন রয়েছে যেগেুলো নিয়ে নজরুল তাঁর বিখ্যাত লেখা গুলো নিখেছেন তা নিয়ে আলোচনা করতে চাই। ইসলামের এই বুনিয়াদ গুলো মেনে চলা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরয। ইসলামের বুনিয়াদি বিষয় যেমন :
ক. কলেমা খ. নামাজ গ. রোজা
ঘ. হজ্ব ঙ. যাকাত
ক. কলেমা-ইসলামের ৫টি রোকনের প্রথমটি হল কলেমা। নজরুল কলেমা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
‘ইসলাম আমার ধর্ম, মুসলিম আমার পরিচয়,
কলেমা আমার তাবিজ, তৌহিদ আমার মুর্শিদ,
ইমান আমার বর্ম হেলাল আমার মুর্শিদ।’
তিনি কলেমা প্রসঙ্গে প্রচুর সঙ্গিত রচনা করেছেন। এর সঙ্গে ঈমান, তৌহিদ, তাবিজ ইত্যাদি বহু বিষয় জড়িয়ে থাকলেও
নজরুল কলেমাকে আলাদাভাবে আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। তিনি কলেমা প্রসঙ্গে লিখেছেন এভাবে,
‘মুখেতে কলমা হাতে তলোয়ার,
বুকে ইসলামী জোশ দুর্ব্বার,
হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লার
চল্ আগে চল্ বাজে বিষাণ।’
ইসলামের প্রথম এই রোকন যিনি তাঁর ভক্ষে ধারণ করতে পেরেছেন তিনিই প্রকৃত পক্ষে আল্লার পথে এসেছেন। আল্লার পথে আসার প্রধান বিষয় হলো কলেমাকে হৃদয়ে ধারন করা। যিনি এই কাজটি করতে পেরেছেন তিনিই মুসলমানদের সারিতে নিজেকে সামিল করেছেন। তাই এর গুরুত্ব অত্যধিক বলে নজরুল তাঁর লেখনিতে তুলে ধরেছেন।
খ. নামাজ-পবিত্র কোরআন শরীফে ৮২ বার আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে,
‘তোমরা নামাজ কায়েম কর।’
নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি যিঁনি ছোট কালে বাবাকে হারিয়ে প্রথম মসজিদের ইমামতির কাজটি করেছেন। তখন নজরুলের বয়স মাত্র ১০ কি ১১ বছর। এই বয়সে শুধু তিনি নামাজ পড়েননি, অন্যকেও নামাজ পড়িয়েছেন। তাই নজরুল নামাজের গুরুত্ব বুঝেছেন খুব ছোটকালে। তিনি নামাজ প্রসঙ্গে লিখেছেন এভাবে,
‘হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড় আজ।
দিলাম তোমার চরণ-তলে হৃদয়-জায়নামাজ।
আমি গুনাহগার বে-খবর
নামাজ পড়ার নাই অবসর
চরণ-ছোঁয়ায় এই পাপীরে কর সরফরাজ।’
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক বলেছেন,
‘আমি জ্বিন এবং মানুষকে আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ কোরআনে আল্লাহ আরো বলেছেন, ‘নামাজ কায়েম কর, নিশ্চয় নামাজ অশ্লীলতা ও দুস্কার্য থেকে মানুষকে বিরত রাখে।’ নামাজ পড়ার সাথে আরো কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গভীরভাবে জড়িয়ে যায়। যেমন ঃ আজান, মসজিদ, ওজু, মুনাজাত ইত্যাদি। নজরুল তাই আজান সর্ম্পকে লিখেছেন,
‘আঁধার মনের মিনারে মোর,
হে মুয়াজ্জিন, দাও আজান।
গাফেলতির ঘুম ভেঙ্গে দাও।
হউক নিশি অবসান।’
আরো লিখেছেন এভাবে,
‘মসজিদে ঐ শোনরে আজান চল নামাজে চল।
দু.খে পাবি সাত্বনা তুই-বক্ষে পাবি বল।
ওরে চল নামাজে চল।’
সর্বচেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গিত ও লেখা মসজিকে নিয়ে কবির এই রকম,
‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই।
যেন গোরে থেকেও মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।
আমার গোরের পাশ দিয়ে ভাই নামাজীরা যাবে,
পবিত্র সেই পায়ের ধ্বনি এ বান্দা শুনতে পাবে।
গোর আজাব থেকে এ গুনাহগার পাইবে রেহাই।’
নজরুল ছিলেন ইসলামী রেঁনেসার কবি। অথচ সেই সময় এমন এক প্রিয় সাধককে মূল্যায়নটাও সঠিকভাবে করতে পারেনি মুসলিম সমাজ। অনেকে তঁকে কাফের বলতেও কুন্ঠাবোধ করেননি, উপাধিও দিয়েছিলেন। পার্থিব জীবনে কবির অনেক গুলো আশা-আঙ্খাকা অপূরনীয় থাকলেও তাঁর জীবনের শেষ আশা টুকু সৃষ্টিকর্তা পূরণ করেছিলেন। মসজিদের পাশে কবর দেয়ার যে ইচ্ছা তিনি পোষন করেছিলেন তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রিয় মসজিদের পাশে কবিকে কবর দেয়া হয়েছে যেখানে শুয়ে কবি প্রতিদিন অসংখ্য মসজিদে আশা মানুষের ইবাদত এবং আজান শুনতে পান। এটা কবির সবচেয়ে বড় সফলতা, ইসলামের প্রতি অনুরাগের পুরস্কার।
গ. রোজা-পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন,
‘রোজা তোমাদের জন্য ফরয করা হয়েছে
যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্থীদের প্রতি।’
কোরআনে আল্লাহ আরো বলেছেন,
‘আমি তোমাদিগকে ভয়-ভীতি ও ক্ষুধা-তৃঞ্চা দ্বারা পরীক্ষা করিব
এবং আমি সবরকারীদের সাথে আছি।’
রোজা হচ্ছে সেই পরীক্ষা যা দুনিয়ার কারো ভয়ে কেউ এই ইবাদত করে না। নামাজ, হজ্ব, যাকাতসহ অন্যান্য ইবাদত গুলো লোক দেখানো হতে পারে, কিন্তু একমাত্র রোজা কারো পক্ষে দেখানো ইবাদত হিসাবে করা সম্ভব নয়। রোজা একমাত্র আল্লাহকে যিনি ভয় পাবেন তার পক্ষে থাকা সম্ভব। তাই রোজাকে আমাদের জাতীয় কবি স্বাগত জানিয়েছেন এভাবে,
‘ফিরে এলো আজি ফের মাহে রমজান
দুনিয়াতে আল্লার বেহেস্তি দান।
একটি বছর পরে
এলো সে মোদের ঘরে
তসলিম জানায়-আমি মুসলিম জাহান।’
মাহে রমজানের মাস বরকতময় ও অত্যন্ত ফযিলতের মাস। ঈমানদার প্রত্যেকটি মানুষ এই মাসটির অপেক্ষায় থাকেন। প্রায় কিতাব সমূহ এই বরকতময় মাসে আল্লাহ নাযিল করেছেন। এই মাসের ফজিলত এত বেশি যে, অন্য যেকোন মাসের ইবাদত চেয়ে এই মাসের ইবাদতকে আল্লাহ তায়ালা অনেক বেশি মর্যাদার মাস হিসাবে ঘোষণা করেছেন। মূলত. মুসলিম সমাজের জন্য এই বরকতময় মাসের ফজিলত শেষ করা যাবেনা। হাদিস শরীফে আছে,
‘বেহেস্তের ৮টি দরজার মধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান, এই দরজা দিয়ে
প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করবেন একমাত্র রোজাদারগন।’
আল্লাহ বলেছেন,
‘রোজা আমার জন্য সুতরাং এর পুরস্কারটাও আমি নিজ হাতে দান করব।’
মোবারক হও মাহে রমজান। এই বক্তব্যটি আমরা দিয়ে থাকি রমজান মাসে। আমরা রমজান মাসে আল্লার কাছে সমগ্র গুণাহ মাফ চেয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করি। যারা ইমানদার তারা রোজা শেষ হলে মানসিকভাবে ছোট হয়ে যান। তাইতো নজরুল লিখেছেন এভাবে,
‘ফুরিয়ে এলো রমজানেরই মোবারক মাস।
আজ বাদে কাল ঈদ, তবু মন করে উদাস।
রোজা রেখেছিলে, হে পরহেজগার মুমিন।
ভুলেছিলি দুনিয়াদারী রোজার তিরিশ দিন।’
রোজা মানুষকে সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। হাদিসে আছে, এক ব্যক্তি আল্লার রসূল (স.) কে প্রশ্ন করেছিলেন রোজার সময় আমার সাথে কেউ ঝগড়া করতে এলে আমি তাঁকে কী বলব ? রসূল বলেছিলেন তাঁকে বিনয়ের সাথে বল ‘আমি রোজাদার’। বলেছিলে তারপরও যদি সে ঝগড়া করতে আসে তাহলে কী বলব, ‘ভাই আমি রোজা রেখেছি।’ রোজার সম্মান এত বেশি যে, রোজা রেখে ঝগড়া বিবাদ করা যাবে না, কারো সাথে মিথ্যা প্রতারনা কিংবা কোন রকম অশান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। রোজার পরে আসে আনন্দের ঈদ। ঈদকেও নজরুল সম্মান জানিয়েছেন নানাভাবে। নজরুলের সেই বিখ্যাত গান ঈদকে কেন্দ্র করে ,
‘রমজানের ঐ রোজা শেষে
এলো খুশির ঈদ।’
এই গানটি দ্বারা নজরুলের ঈদ, রোজা ও ইসলাম সর্ম্পকে যে বিশ্বাস ও দৃঢ়তা তার একটি সঠিক চিত্র তুলে দরেছেন। ফুটে উঠেছে ইসলামী আকিদার, সম্মানিত করেছেন ইসলামকে।
ঘ. হজ্জ-ইসলামের আরেকটি অন্যতম রোকন হচ্ছে হজ্জ। সমাজের বিত্তশালী সকল মানুষের জন্য হজ্জ ফরয। আল্লাহ কোন মানুষকে জোর করে অথবা সাধ্যের বাইরে কোন কিছু করতে বলেননি। নামাজ সকলের জন্য ফরয করা হলেও হজ্জটা শুধু ঐ সমস্ত লোকের জন্য ফরয করেছেন যার কাছে প্রচুর অর্থ আছে। হজ্জ হচ্ছে সারা জীবনের ইবাদতের সৌন্দর্য। হজ্জ এক বিশ্ব সন্মেলন। পবিত্র হাদিস শরিফে মুহাম্মদ (স.) বলেছেন এভাবে,
‘পবিত্র হজ্জ পৃথিবী ও তার সমুদয় পদার্থ হতে উত্তম। হজ্জ কখনও বিফলে যায় না।’
মেশকাত শরীফে বর্ণনা আছে এভাবে,
‘হজ্বের দিন বা আরাফার দিন আল্লাহতায়ালা সর্বনিম্ন আসমানে তশরীফ আনেন
এবং লাব্বায়েক ধ্বনি উচ্চারণকারী হাজীদের সকল গুনাহ তিনি মাফ করে দেন।’
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল কাবা জিয়ারত বিষয়ে লিখেছেন এভাবে,
‘বক্ষে আমার কা’বার ছবি
চক্ষে মুহাম্মদ রসূল।’
কবি আরো লিখেছেন,
‘ইয়া রাসুলুল্লাহ। মোর রাহ দেখাও সেই কাবার
যে কাবা মসজিদে গেলে পাব আল্লার দীদার।
দীন দুনিয়া এক হয়ে যায় যে কাবার ফজিলতে
যে কাবাতে হাজী হ’লে রাজী হন পরওয়ার দিগার।’
কবি আরো গাহিয়াছেন,
চলরে কা’বার জিয়ারতে, চল নবীজির দেশ।
দুনিয়াদারির লেবাস খুলে’ পররে হাজীর বেশ।
আওকাতে তোর থাকে যদি আরাফাতের ময়দান
চল আরাফাতের ময়দান,
এক জামাত হয়, সেখানে ভাই নিখিল মুসলমান।’
কবি মদিনায় যাওয়ার যে আকুতি তাঁর লেখনিতে বার বার উচ্চারণ করেছেন তাতে একথা নি.সন্দেহে বলা যায় যে, নজরুল ইসলামের প্রতি কতটা অবিচল ছিলেন এবং সত্যিকার মুসলিম হলে কি করতে হয়। তিনি মদিনায় যাওয়ার আকুতি হিসাবে লিখেছেন,
কা’বার জিয়ারতে তুমি কে যাও মদিনায় ?
আমার সালাম পৌঁছে দিও নবিজির রওজায়।
হাজীদের ঐ যাত্রা পথে
দাঁড়িয়ে আছি সকাল হ’তে।
কেঁদে বলি, কেউ যদি মোর
সালাম নিয়ে যায়।’
এভাবে মক্কা, মদিনা ও হযরত মুহাম্মদ (স.) তথা ইসলামকে সন্মান করেছেন এবং মুসলামদের ইসলামের প্রতি সর্বচ্চো বিশ্বাস তৈরি করতে তাদিগ দিয়েছেন।
ঙ. যাকাত- ‘দে যাকাত, দে জাকাত, তোরা দে’ রে জাকাত।
তোর দিল খুলবে পরে-ওরে আগে খুলুক হাত।
দেখ্ পাক কোরআন, শোন, নবিজির ফরমান।
ভোগের তরে আসেনি দুনিয়ায় মুসলমান।
তোর একার তরে দেননি খোদা দৌলতের খেলাত।’
ইসলামের ৫ম বুনিয়াদ হলো যাকাত। যাকাত নামাজের সাথে সম্পৃক্ত। কোরআনে যতবার নামাজের কথা বলা হয়েছে পাশাপাশি যাকাতের কথাও ততবার বলা হয়েছে। ইসলামে এই বিষয়টি শুধু ধনী এবং গরিবের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে সমাজে শান্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করার একটি প্রকৃষ্ট প্রথ বলে আল্লাহ ঘোষনা করেছেন। যে সমাজে সঠিক পথে যাকাত ব্যবস্থা চালু আছে সেই সমাজে কোন দিন গরীব বলতে কিছু থাকবে না। আজকাল লোক দেখানো আমাদের যে যাকাত ব্যবস্থা চালু আছে তা ইসলাম কোনদিন গ্রহণ করে না। হযরত ওমর (রা.) আমলে এমন এক যাকাত ব্যবস্থা চালু ছিল যেখানে যাকাত দেয়ার মত কোন লোক খুজে পাওয়া মুশকিল ছিল। একসময় সকল মানুষ স্বনির্ভর হয়ে গিয়েছিল, সঠিক যাকাত ব্যবস্থা চালু থাকার কারনে। আমাদের সমাজেও সেই যাকাত পদ্ধতি চালুর বিষয়ে কবি নজরুল সকল ধনবানকে তাগিদ দিয়েছেন ।
নজরুল গোড়া মুসলিম সমাজে ও পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেও সকল ধর্মকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ভুল করেননি। ধর্ম সর্ম্পকে নজরুলের আলাদা একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাদের বাড়ির সামনে পিপুকুরে মসজিদ স্থাপনের মাধ্যমে পারিবারিক ধর্ম চর্চা শুরু হলে সেখান থেকে সমাজে ইসলাম প্রচার এবং নজরুল এক সময় সেই মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে ইসলামের প্রতি তার অনুভুতি সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় অসংখ্য কবিতা, গান তিনি ইসলাম তথা মুসলিম সমাজকে নিয়ে রচনা করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইসলামের যে ৫টি বুনিয়াদ নিয়ে নিখেছেন তা থেকে কাজী নজরুল ইসলামের ইসলাম চর্চার একটি সংক্ষিপ্ত রূপ ফুটে উঠেছে। সর্বপরি ইসলাম, ইসলামী উন্মাহর প্রতি নজরুলের অসীম শ্রদ্ধা ভালবাসার এটি শ্রেষ্ঠ প্রমান। এছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন কাব্যে আমপারা, মরুভাস্করসহ অসংখ্য ইসলামী হামদ, নাত ও সঙ্গিত। আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা নজরুলের ইসলামী চেতনাকে তুলে ধরতে পারিনি এটি জাতি হিসাবে আমাদের ব্যর্থতা। তাই সময়ের প্রয়োজনে এই সবের আরো বেশি বেশি আলোচনা, গবেষনা এবং চর্চা হওয়া উচিত। এতে মুসলিম বিশ্বের কাছে বাঙ্গালি মুসলমানদের আরো সন্মান বাড়বে এবং বাংলাদেশ আলোকিত হবে।
লেখক :
নজরুল গবেষক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অধ্যক্ষ, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এণ্ড কলেজ