নকল বাণিজ্য সিন্ডিকেটের হোতা পোরশা ডিগ্রি কলেজের দুই শিক্ষক
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নওগাঁর পোরশা ডিগ্রি কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্র যেন নকলের আখড়াখানা। এই কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা পরীক্ষার্থী যে যত বেশি টাকা দিবেন সে তত বেশি নকল করার সুযোগ পাবেন। এভাবেই চলছে গত কয়েক বছর যাবৎ। কলেজটিতে নকল বাণিজ্যের প্রধান সিন্ডেকেটে রয়েছেন কলেজটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক আবু ইলিয়াসও বাংলা বিভাগের প্রভাষক ইব্রাহিম আজাদ।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুন মাসে কলেজটির অধ্যক্ষ রেজাউল করিম অবসরে যাওয়ার পর অত্র কলেজের উপাধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও ২০২১ সালের মার্চ মাসে অবসরে যান। তিনি অবসরে যাওয়ার পর মিজানুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব অর্পন করেন। প্রায় দুই বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ সালে মিজানুর রহমান অবসরে যান। এরপর কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান এটিএম শহীদ। তবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এই দায়িত্ব যে-ই এসেছেন নকল বাণিজ্য সিন্ডিকেটের মুল হোতা ঐ দুই শিক্ষককে পরীক্ষা কমিটিতে দায়িত্ব দিয়ে নকল বাণিজ্য করে প্রাপ্ত অর্থের ভাগ নিয়েছেন। ফলে প্রতিবারই পরীক্ষা কমিটিতে এই দুই শিক্ষক স্থান পেয়েছেন। তবে এ যাবতকালে প্রতিষ্ঠানটিতে যত যনই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়েছেন তাদের মধ্যে নকল বাণিজ্যে এই দুই শিক্ষককে ওপেন করে দিয়েছিলেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান দায়িত্ব থাকাকালীন এই দুই শিক্ষক চালিয়েছিলেন নকলের মহোৎসব। বই কেটে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে নকল সরবরাহ করলে এক ধরণের আর্থিক মূল্য, সরাসরি বই দেখে লেখার সুযোগ দিলে এই মূল্য কয়েকগুণ বৃদ্ধি। এভাবেই নকলের এক ধরণের বাণিজ্যে পরিণত করেছেন এই দুই শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান অবসরে গেলেও এই দুই শিক্ষকের একই কর্মকান্ড কোনভাবেই থেমে নেই।
আরও পড়ুনঃ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অবসরে গেলেন পোরশা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ!
জানা গেছে, পোরশা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা সাপাহার সরকারি ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয় এবং সাপাহার সরকারি ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থীরা পোরশা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দেন। অনার্স প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত, ডিগ্রি প্রথম বর্ষ থেকে তৃতীয় বর্ষ, এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি প্রথম বর্ষ থেকে ৩য় বর্ষের পরীক্ষা পোরশা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়।
অনার্স ১ম, ২য় , ৩য় ও ৪র্থ বর্ষ পরীক্ষা কমিটি, ডিগ্রী সাধারণ পরীক্ষা কমিটি, ডিগ্রী উন্মুক্ত পরীক্ষা কমিটি ও ভর্তি ও ফরম ফিলাপ কমিটিতে পর পর কয়েক বছর ধরে রয়েছেন নকল বাণিজ্য সিন্ডিকেটের অন্যতম প্রধান হোতা ঐ দুই শিক্ষক। শিক্ষক আবু ইলিয়াস স্টাফ কাউন্সিলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
শিক্ষাবার্তা'র অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ডিগ্রী উন্মুক্ত পরীক্ষায় নকল সরবরাহ করে প্রভাষক আবু ইলিয়াস এবং প্রভাষক ইব্রাহিম আজাদ ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে জন প্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা করে নিয়েছেন। এই টাকার বিনিময়ে বইয়ের পাতা কেটে নকল সরবরাহ করেন এই দুই শিক্ষক। এছাড়া উন্মুক্তের সকল পরীক্ষায় নকল সরবরাহের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সকল পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে তারা আদায় করেন জনপ্রতি ২০০ টাকা করে। গত অনার্স ২য় বর্ষের পরীক্ষায় ঐ দুই শিক্ষকের সিন্ডেকেট মিলে ইংরেজী পরীক্ষায় জনপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে হলের বিভিন্ন রুমে উত্তর পত্র সরবরাহ করেছিলেন। পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে নকল সরবরাহের পরিবেশ তৈরি করতে তাদের পছন্দের বিশেষ শিক্ষকদের পরীক্ষার হলে দায়িত্ব প্রদান করেন তারা। এছাড়া কেন্দ্র ফি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ পরীক্ষার দায়িত্ব থাকা শিক্ষকদের মধ্যে বিতরণ না করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের (এর আগে যখন যেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পেয়েছেন) সহায়তায় নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেন এই দুই শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। শিক্ষকদের প্রাপ্য পরীক্ষা রিমিউনেশনের টাকা প্রদান না করে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে সাথে নিয়ে কেন্দ্র ফির সমুদয় টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেন তারা। পরীক্ষা রিমিউনেশনের টাকা না পেয়ে কোন শিক্ষক প্রতিবাদ করলেন তাকে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। এরপর বহিরাগত অতিথি শিক্ষক দিয়ে পরীক্ষার দায়িত্ব দেন। অনার্স পরীক্ষার বিভিন্ন সময়ে তাদের মনোনীত বহিরাগত অতিথি শিক্ষকদের পরীক্ষার ডিউটি দিয়ে টাকার বিনিময়ে বিশেষ বিশেষ রুমে নকল করার সুযোগ করিয়ে দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক লক্ষ টাকা। তবে কলেজের এই দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান এর আমলে। তিনি কলেজটিতে দুর্নীতির চ্যাম্পিয়ন ছিলেন।
শিক্ষাবার্তা'র হাতে আসা ভিডিও বার্তায় দেখা গেছে, প্রভাষক আবু ইলিয়াস এবং প্রভাষক ইব্রাহিম আজাদ বই কেটে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন তারা সেটা দেখে দেখে লিখছেন। এর বাইরে কিছু শিক্ষার্থী সরাসরি বই দেখে লিখছেন, বই সরবরাহ করছেন এই দুই শিক্ষক। শুধু বই সরবরাহ করেই ক্ষ্যান্ত হননি এই দুই সিন্ডিকেট, যারা বই দেখে লিখছেন তারা যেন নির্বিঘ্নে লিখতে পারেন তার জন্য আলাদা পাহাড়াও বসিয়ে রেখছেন তারা।
নকল বাণিজ্য বাঁধা দেওয়া এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরীক্ষা কমিটির শীর্ষ এই দুই শিক্ষক ওপেনে নকল বাণিজ্য করছিলেন আমি বাঁধা দিলে আমাকে অধ্যক্ষের রুমে নিয়ে গিয়ে সতর্ক করেন। আমি যদি নকলে বাঁধা দেই তাহলে আমাকে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যহত দেওয়া হবে। শুধু পরীক্ষা থেকে অব্যাহতিই নয় আমাকে কলেজের অন্যান্য বিষয় নিয়েও হেনস্তা করা হবে। ফলে আমার আর বাঁধা দেইনি।
এই শিক্ষক আরও বলেন, এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি নকল সরবরাহ হয় ডিগ্রি পাস কোর্সের পরীক্ষায় এবং স্নাতক পর্যায়ের ইংরেজি পরীক্ষায়। এই দুই পরীক্ষায় প্রায় এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নকল সরবারহ করার জন্য মোটা অংকের টাকা নেওয়া হয়। আর এই টাকার ভাগ পেতেন সাবেক অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান। রক্ষক যখন ভক্ষক ছিলেন তখন এটা রোখার ক্ষমতা কার আছে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
তবে কলেজটির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সুরেন্দ্র নাথ উপাধ্যক্ষ এবং পরবর্তীতে অধ্যক্ষ হবার পর থেকে এই নকল বাণিজ্যের যাত্রা শুরু হয় মূলত কলেজটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক সিরাজুল ইসলাম এবং রসায়ন বিভাগের প্রভাষক সুনিল চন্দ্র পালের মাধ্যমে। সিরাজুল ইসলাম এবং সুনিল চন্দ্র পাল সাবেক অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান ও সদ্য সাবেক অধ্যক্ষ এটিএম শহীদ এর সময়কাল পর্যন্ত পরীক্ষা কমিটিতে ছিলেন এবং নকল বাণিজ্যের এই স্ক্যাম চালিয়েছিলেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রভাষক ইব্রাহিম আজাদ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এটা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমাকে কেউ হয়তো ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। আমি এরকম কিছু করিনি। ভিডিওতে দেখা গেছে উল্লেখ করলে বিষয়টি ভিত্তিহীন বালি দাবি করেন তিনি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক আবু ইলিয়াস শিক্ষাবার্তা'র কাছে নকল সরবরাহ ও নকলের বিনিময়ে অর্থ আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, আমাদের কলেজে শুধু আমি নয় এই ধরণের ঘটনা আগে কখনও ঘটেছে বলে আমি শুনিনি। সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান এর সময়কালে আপনাকে নকল সরবরাহ এবং নকলের বিনিময়ে অর্থ আদায় করতে দেখা গেছে এক ভিডিও ক্লিপসে এ বিষয়ে তিনি জানান, তিনি এর সাথে জড়িত নয়। ভিডিও ক্লিপসে আপনার চেহারা সদৃশ্য অন্য কেউ হতে পারে কি'না জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমার চেহারা সদৃশ্য অন্য কেউ হবে না তবে সেটা আমিও না।
এ বিষয়ে কলেজটির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আকতারুজ্জামান শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমি এই কলেজে দায়িত্ব নিয়েছি চলতি মাসের ১১ তারিখে। গত অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ছিলাম আমি সে সময়ে শিক্ষকদের প্রাপ্য পরীক্ষার রিমিউনেশনের ৪৭৫ টাকা করে পরিশোধ করেছিলাম। যা এ যাবতকালে কেউ করেনি। শুধু শিক্ষকদের নয় এই রিমিউনেশনের অর্থ দিয়েছি সুইপার থেকে কর্মচারী পর্যন্ত। এছাড়া আয় ব্যয়ের হিসাব ওপেন হাউজে তুলে ধরেছিলাম। আগে কি হয়েছি কি হয়নি তা তো আমি বলতে পারব না তবে আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে পরীক্ষায় কোন প্রকার অসুদাপায় অবলম্বন করার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে পোরশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা আক্তার শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আপনার কাছে এই প্রথম এই সংবাদ আমি শুনলাম কেউ অভিযোগ করলে বা তথ্য প্রমাণ পেলে তার ভিত্তিতে আমি প্রয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
জানতে চাইলে নওগাঁর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইসিটি ও শিক্ষা) এস এম জাকির হোসেন শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই তবে তথ্য প্রমান আমাকে দেখান এবং জমা দিন এর ভিত্তিতে আমি তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২১/০৬/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়