দেশ বরেণ্য শিক্ষাবিদরা ভিসি হতে চান না- ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
একসময় দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের চেহারা দেখলেই মনটা বড় হয়ে যেত। ভাবতাম ইশ! আমি যদি তাঁদের মত হতে পারতাম? এখন আর তেমন আশা করি না। এখন কোন ভিসি গণমাধ্যমে কথা বলা শুরু করলে মনেহয়-এইতো তোষামোদি তেলবাজি শুরু। তারা অধিকাংশই ছাত্রদের জন্যও কথা বলতে পেছনে তাকান, ছাত্রদেরও অভিভাবক হতে চান না। বিশেষ দল, মত ও আদর্শ প্রচারের মুখপাত্র হয়ে উঠেন।
আমি অনেক কম জানা একজন। তবুও মাঝে মাঝে তাদের বক্তব্য শুনলে মনেহয় ভালোই আছি। বহু অনুষ্ঠানে গিয়ে হতাশ হয়েছি। আমাদের ভিসিদের এই অবস্থা যেখানে-সেখানে শিক্ষার মান কোথায়? কোন পর্যায়ে? সেটি অনুমানের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থার দরকার হবে না, সাদা চোখেই অনুমান করা যায়।
মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বিল-২০২২ পাসের আলোচনায় বরেণ্য শিক্ষাবিদদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী নন বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের খুবই বরেণ্য শিক্ষকরা আছেন যাদের উপাচার্য হিসেবে পেলে গর্ব অনুভব করতাম। কিন্তু তাদের অনেকেই এই প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে চান না। আমরা চাইলেও সবচেয়ে ভালো কেউ আগ্রহী হবেন বিষয়টি তেমন নয়।’
দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরা বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় উপাচার্য বা শিক্ষক নিয়োগের ঘটনা নতুন নয়। সমস্যাটা দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরই এর সূচনা। ১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকারের যাত্রার পর তা প্রকট হতে শুরু করে। আর বর্তমানে তা উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। তবে এই অবস্থার আশু উন্নতি দরকার। আর তা একমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের মাধ্যমে ও দীর্ঘ প্রচেষ্টায় অর্জন সম্ভব।
বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে চান না-এটা ঢালাও বক্তব্য। সম্মান আর শিক্ষার কারণেই উপাচার্য হওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই আগ্রহ থাকে। কিন্তু এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রক্রিয়া থাকা দরকার। সেটা নেই। চলে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। আইন পরিবর্তন করে সুনির্দিষ্ট গুণাবলির আলোকে শিক্ষকদের মাধ্যমে গঠিত বাছাই কমিটি উপযুক্ত উপাচার্য খুঁজে বের করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বাধা রাজনীতির প্রভাব। সরকার চাইলেই এর সমাধান সম্ভব।
বর্তমানে সৎ ব্যক্তি উপাচার্য আছেন। আবার এমন অনেককে উপাচার্য করা হয়েছে যাদের ন্যূনতম প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের রেকর্ড নেই। আগে থেকেই সততা নিয়ে প্রশ্ন আছে কিংবা প্রথম মেয়াদে বিতর্কিত কাজ করেছেন-এমন ব্যক্তিও উপাচার্য হয়েছেন, হচ্ছেন। বড় চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল উপাচার্য নিয়োগে আইন আছে। অন্যগুলোতে নিয়োগের কোনো নিয়ম নেই। কেবল মন্ত্রণালয় খুঁজে বের করে। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ নাতির বয়সি রাজনীতিকদের কাছে গিয়ে ধরনা ধরেন। ছাত্রদের দিয়ে তদবির করানোর রেকর্ডও আছে। আমলাদের কেউ কেউ এ ক্ষেত্রে ত্রাতার ভূমিকায় আছেন।
এমন পরিস্থিতি একদিনে নয়-দীর্ঘদিনে তৈরী হয়েছে। তৈরী করা হয়েছে। কারণ এই ভিসিদের দিয়ে নানামুখী অনৈতিক কাজ করানো সম্ভব। গত ১৩ বছর একটি দল ক্ষমতায়। এই ১৩ বছরে বহু ভিসিকে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলন হয়েছে। আমার কেন জানি মনেহয় শিক্ষার বারোটা বাজিয়েছে এই ভিসিরা, আর মানুষের সকল সন্মান, শ্রদ্ধা, একদিনের গণতন্ত্রকে লাটে তুলেছে হুদারমত ইসিরা।
আজকে প্রথম আলোর একটি নিউজ শ্রীলংকার মত এককটি দেশ যাদের শতভাগ শিক্ষিত মানুষ-সেটাকে ডুবিয়েছে একটি পরিবার। পরিবারতন্ত্র যেমন দেশ ডুবায়। একজন তেলবাজ ভিসি শিক্ষা ডুবায়। আর হটকারী ইসি গণতন্ত্র ডুবায়। শিক্ষামন্ত্রীর উপলব্দি সঠিক, তবে এটি আরো বিশেষ বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে। কারণ বরেণ্য ব্যক্তিরা তো তৈলবাজি, তোষামোদি করতে পারবে না, সুতরাং তারা কেনই বা এমন পরিস্থিতিতে আসবেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই চিত্র একটি বিশেষ ছাত্র-সংগঠনের সকল বিষয়ে একমত হতে হবে ভিসিকে। এটি তো বরেণ্য শিক্ষাবিদদের পক্ষে অসম্বব। তাই বিষয়টির গভীরে না গিয়ে ঢালাওভাবে শিক্ষাবিদরা আসেন না-এটি বা কতটুকুন যৌক্তিক। যেসকল শিক্ষাবিদরা নূন্যতম সন্মান রাখেন তারা বিশেষ ছাত্র সংগঠন, নামমাত্র দলীয় নেতার চোখ রাঙানো সইবেন? নিশ্চয়ই সইবেন না। তাহলে প্রথমত যেটি দরকার সেটি হল পরিবেশ তৈরী করা। পরিবেশ তৈরী না করে এমনটি আশা করাও অযোক্তিক।
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের আরেকটি দিক হল, যোগ্য ব্যক্তিরা নানাক্ষেত্রে আসেন না। কারণ তারা সেই সন্মান পান না। পাচ্ছেন না। অথচ প্রতিটি পদের জন্য প্রায় সকল ব্যক্তিই কাজ করেন , আশা করেন। অনুমান করা যায়? আমরা কোনদিকে যাচ্ছি? আমাদের অবস্থা কি? এমন পরিস্থিতি দেখতে ও শুনতে হবে স্বাধীনতার এতটা বছর পর নাগরিক হিসাবে ব্যথিতবোধ করি। শুধু বলি, শুভবুদ্ধির উদয় হউক সকলের। বিশেষত ক্ষমতাসীনদের।