ঘুরে দাঁড়াবে বাগেরহাটের পর্যটনশিল্প, বাড়বে রাজস্ব আদায়
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
পর্যটনশিল্পের এক সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে বাগেরহাটের সুখ্যাতি রয়েছে। এখানে বিশ্ব-ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবনের অবস্থান। পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পর্যটকের আগমন ঘটে এ জেলায়। সহজ যোগাযোগব্যবস্থা ও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে দীর্ঘ দিন পর্যটনশিল্পের অপার সম্ভাবনাময় জেলা বাগেরহাটে পর্যটনশিল্পের তেমন বিকাশ ঘটেনি। তবে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এবার নতুন আশায় বুক বাঁধছেন পর্যটনশিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা।
পর্যটনশিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাগেরহাটে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য যাতায়াতের প্রধান ব্যবস্থা হচ্ছে সড়কপথ। আর এই সড়কপথে সহজ যোগাযোগব্যবস্থা না থানায় ব্যবসাবাণিজ্যে পণ্য পরিবহনে যাতায়াতে মাওয়াঘাটে যানজট, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকাসহ নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। সময় মতো পৌঁছানো যেত না গন্তব্যে। তবে পদ্মা সেতু চালুর মধ্য দিয়ে চিরচেনা সেই দুর্ভোগময় পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে যাবে দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের।
ঘুরে দাঁড়াবে সম্ভাবনাময় বাগেরহাটের পর্যটনশিল্প। সরকারের রাজস্ব বাড়বে কয়েক গুণ। যা বলছেন টুরিস্ট গাইড ও ব্যবসায়ীরা : বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের বাসিন্দা ট্যুরিস্ট গাইড নিয়ামুল ইসলাম বলেন, বিশ্ব-ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও সুন্দরবন দেখতে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সমাগম সাথে প্রায় সারা বছর জুড়ে। পর্যটন মৌসুম বাদেও বছরের প্রায় সবসময়ই কমবেশি দর্শনার্থীদের আগমন ঘটে বাগেরহাটে। বাগেরহাটের আসতে মাওয়াঘাটে জ্যামসহ নানা কারণে ইচ্ছা থাকলেও পর্যটকরা সহজে আসতে পারত না। এ ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে জেলার পর্যটন-স্পটগুলোর আশপাশে উন্নত মানের কোনো খাবার হোটেল ও থাকার ব্যবস্থা না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে পর্যটকদের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো।
আশা করছি পদ্মা সেতু চালুর পর এ সমস্যাগুলো আর থাকবে না। ভ্রমণপিপাসুরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাদের ভ্রমণ শেষে ফিরে যেতে পারবে। এ ছাড়া পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি পেলে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে নানা স্থাপনা তৈরি হবে। হাজার হাজার বেকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। বাগেরহাট খানজাহান আলী (রহ:) মাজার এলাকার হোটেল ব্যবসায়ী মো: কামরুজ্জামান বলেন, পর্যটন মৌসুম ছাড়া বাগেরহাটে পর্যটকদের আনাগোনা কম থাকে। এ কারণে হোটেল ব্যবসায়ীদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। পদ্মা সেতু খুলে দিলে, বছরজুড়ে পর্যটকদের আগমন ঘটবে বাগেরহাটে। চাপ থাকবে হোটেল-মোটেলগুলোতে। নতুন নতুন হোটেল-মোটেল তৈরি হবে, বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগও।
কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পাবে সরকার। বাড়বে রাজস্ব আদায় : পদ্মা সেতু খুলে দেয়া সরকারি রাজস্ব আদায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে দাবি করছেন বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো: যায়েদ। তিনি বলেন, স্বপ্নে পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের চাপ বাড়বে মসজিদের শহর বাগেরহাটে। এতদিন সহজ যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় দর্শনার্থীদের আগমন কম ছিল।
এখন পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে দর্শনার্থীরা দিনে দিনে ভ্রমণ করে আবার ফিরে যেতে পারবে। চলতি অর্থবছরে ষাটগম্বুজ মসজিদে দেশী-বিদেশী পর্যটক এসেছে প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ আর রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৫৫ লাখ টাকা। পদ্মা সেতু খুলে দেয়া হলে পর্যটকদের সংখ্যা দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ও দুই থেকে তিন গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। পর্যটকদের চাপ সামলাতে পূর্ব সুন্দরবনে নতুন চারটি পর্যটন-স্পট : পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই চাপ বাড়বে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে।
এ কারণে পর্যটকদের বাড়তি বিনোদন দিতে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ও পশ্চিম সুন্দরবনে তৈরি করা হচ্ছে চারটি নতুন পর্যটন-স্পট। নতুন এ পর্যটন-স্পটগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হলেই ঘুরতে আসা দেশি-বিদেশী পর্যটকরা সুন্দরবনের রূপবৈচিত্র্য উপভোগ করার পাশাপাশি বাড়তি আনন্দ পাবেন বলে দাবি করছেন বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: বেলায়েত হোসেন।
তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের বিকাশে পূর্ব শর্ত হচ্ছে উন্নত ও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় সুন্দরবনে দর্শনার্থীদের আগমন কম ছিল। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে এ সমস্যা আর থাকছে না। দেশী-বিদেশী পর্যটকরা সহজে সুন্দরবনে আসতে পারবে।
এ কারণে পর্যটকদের চাপ সামাল দিতে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাবে দু’টি ও পশ্চিম সুন্দরবনে দু’টিসহ মোট চারটি নতুন ট্যুরিস্ট স্পট তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমানে যে ট্যুরিস্ট স্পটগুলো রয়েছে সেগুলো ওয়াচ টাওয়ার, ফুট ট্রেইলার, গোল ঘর ও পাবলিক টয়লেটসহ অবকাঠামোগত নানা উন্নয়ন করা হচ্ছে। সরকার কী পরিমাণ রাজস্ব পাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, প্রতি বছর সুন্দরবনে এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার পর্যটক সুন্দরবনে ঘুরতে আসে। এ অর্থবছরে পর্যটন খাত থেকে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে।
পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর্যটক দ্বিগুনের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ও দ্বিগুণ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। পর্যটনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে বাগেরহাটকে : শুধু ষাটগম্বুজ মসজিদ বা সুন্দরবন নয়, বাগেরহাটে দেখার মতো আরো অনেক স্থাপনা রয়েছে দাবি করেছেন বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মো: আজিজুর রহমান।
তিনি বলেন, মসজিদের শহর বাগেরহাটকে দেশী-বিদেশী মানুষের কাছে আরো পরিচিত করতে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘ দিন আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা ও আবাসন সুবিধা না থাকায় বাগেরহাট ভ্রমণে দর্শনার্থীদের আগ্রহ কম ছিল; কিন্তু স্বপ্নের পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর সহজেই বাগেরহাটে আসতে পারবেন পর্যটকরা।
এর আগে ফেরিঘাটেই সাত-আট ঘণ্টা ব্যয় হয়ে এখন মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যেই পর্যটকরা বাগেরহাট আসতে পারবে। দেশী-বিদেশী পর্যটকদের কাছে বাগেরহাটকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পর্যটন করপোরেশনের অর্থায়নে ১২ কোটি ৭৭ লাখ ছয় হাজার টাকা ব্যয়ে একটি তিন তারকা মানের হোটেল ভবন নির্মাণের কাজ প্রায় ৮০ ভাগ শেষ হয়েছে।
ষাটগম্বুজ মসজিদের সামনে বিশ্রামাগার নির্মাণ, মসজিদ সংলগ্ন ঘোড়াদিঘিকে নান্দনিক করতে ওয়াকওয়ে তৈরি করা বাগেরহাটকে পর্যটকবান্ধব করার জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১০০ জনকে ট্যুরিস্ট গাইড হিসাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শুধু সরকারিভাবে নয়, ব্যক্তি উদ্যোগে দৃষ্টিনন্দনের হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপন তৈরি করার পাশাপাশি উদ্যোক্তা হতে হবে। এর ফলে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এখানকার মানুষের জীবনমান আরো বৃদ্ধি পাবে।