গবেষণায় অনুদান: স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণার জন্য অনুদান প্রদান করে থাকে। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিল মাসে ঐ গবেষণা অনুদানটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকদের নিজ হাতে তুলে দেন। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রদান করা হয়ে থাকে গবেষণা অনুদান। তন্মধ্যে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফিলোশিপ, প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রকল্প, বিজ্ঞানভিত্তিক পেশাজীবী সংস্থা/সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সেমিনার ও প্রদর্শনী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক/গবেষকদের জন্য বিশেষ গবেষণা অনুদান অন্যতম।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩-২০২৪ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় মোট ৫৭১ জনকে দেশে ও বিদেশে এমএস, পিএইচডি ও পোস্ট ডক্টরালের জন্য ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে। এই পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের আওতায় মোট ২৯ হাজার ৬১২ জন শিক্ষার্থীকে ১৮০ কোটি ৯১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৫০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকদের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স, মেডিক্যাল সায়েন্স, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স, ফিজিক্যাল সায়েন্স ও ইন্টার ডিসিপ্লিনারি গ্রুপে ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত ৬ হাজার ৩৯৮টি প্রকল্পের অনুকূলে মোট ২২১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক গবেষণা খাতে এই অনুদান প্রদানের বিষয়টি বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাচ্ছে।
প্রধানন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ মার্চ ২০২৪ তার কার্যালয়ের শাপলা মিলনায়তনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য নির্বাচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ১০ জনকে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ, ১৯ জনকে বিশেষ গবেষণা অনুদান ও ২৫ জনকে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ নিজ হাতে তুলে দিয়েছেন। এই সব ফেলোশিপের আওতায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ রয়েছে। বলতেই হয়, এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য নির্বাচিত ফেলোগণ ও গবেষকবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নির্বাচিত ফেলোবৃন্দ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। গবেষণার মাধ্যমে তাদের অর্জিত ফলাফল দেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বড় ভূমিকা রাখবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্বের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত হচ্ছেন। ফলে একদিকে যেমন গবেষণার দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তিও অলংকৃত হচ্ছে। তাছাড়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান বাংলাদেশে প্রয়োগের সুযোগ তো থাকছেই।
মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির সংখ্যা ও শিক্ষার গুণমান বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই দূরদর্শী চিন্তার একমাত্র কারিগর ও বিজ্ঞানী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশে প্রায় ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আবার ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদনও রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্তারে সহায়ক হবে। বাংলাদেশে পুরাতন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুযোগ-সুবিধা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় অনেক বেশি। আবার অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব মানের ল্যাবরেটরি থাকা সত্ত্বেও গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএস ও পিএইচডি ডিগ্রির জন্য থিসিস বাধ্যতামূলক সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য নিয়মিত অর্থ বরাদ্দ অতীব জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় অর্থ বরাদ্দ কম হওয়ায় গবেষণার মানও নিম্নমুখী। সেক্ষেত্রে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের গুণমানসম্পন্ন থিসিস করতে অনেকটা হিমশিম খেতে হয়। আর এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক বরাদ্দকৃত গবেষণা অনুদান গবেষণাভিত্তিক ডিগ্রি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ও রাখবে।
মনে রাখতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছাড়াও গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের প্রভাষক থেকে গ্রেড-১ অধ্যাপকে পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হয় অনেক ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে প্রতি বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের গবেষণার জন্য যে বিশেষ গবেষণা অনুদান দিয়ে যাচ্ছে, তাতে করে গবেষণালব্ধ ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশের পাশাপাশি তাদের পদোন্নতির জন্য দক্ষতা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নতুন নতুন আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে বলেছেন, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া একটি দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র ও গবেষকদের গবেষণায় মনোযোগ বাড়ানোর উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কৃষিবিজ্ঞানের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, কৃষিক্ষেত্রে গবেষণার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে খরা, লবণাক্ত ও জলমগ্ন সহিষ্ণু ধানের চাষাবাদ হচ্ছে, যা বিজ্ঞানীদেরই গবেষণার ফলাফল।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, গবেষণার মাধ্যমে মানসম্মত ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি মানুষকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, বিদেশিদের পাশাপাশি বাংলাদেশি বহু বিজ্ঞানী পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনে অবদান রেখেছেন। আশা করা যাচ্ছে যে, বাঙালি জাতি তাদের গবেষণার মাধ্যমেই বিশ্বের মানচিত্রে নিজেদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশে আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্র পাবনাতেই স্থাপিত হবে। এর ফলে বিদ্যুত্ উত্পাদনের ঘাটতি পূরণের পাশাপাশি ভবিষ্যতে প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার দ্বার উন্মোচিত হবে।
গবেষণার মাধ্যমে একটি দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার কাজটি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। লক্ষণীয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, কানাডা ও ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে নতুন নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উদ্ভাবিত হচ্ছে। এসব উত্পাদিত পণ্য ও প্রযুক্তি প্যাটেন্টের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ নিজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা তহবিল আরো বাড়ানো যায়, তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও উন্নত দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নতুন পণ্য আবিষ্কারের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারবে বলে আশা করা যায়। এর ফলে ভিশন ২০৪১-কে সামনে রেখে গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সহজতর হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানীরা স্মার্ট বাংলাদেশ তথা স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সমাজ, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট অর্থনীতি গঠনে ভূমিকা রাখবেন।
লেখক : অধ্যাপক, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৫/০৩/২০২৪