কোচিং বাণিজ্য বন্ধে কঠোর হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়
লাবিন ক্লাস নাইনের ছাত্রী, পড়ে রাজধানীর এক স্বনামধন্য স্কুলে। ভবিষ্যতে সে মেডিকেল সায়েন্সের ওপর উচ্চশিক্ষা নিতে চায়। এজন্য স্কুলে সে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়েছে। গণিত ও পদার্থসহ বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে সে বরাবরই ভালো নাম্বার পেয়ে থাকে। তাই সে প্রথম দিকে কোচিং ক্লাসে যেতে চায়নি। কিন্তু ওইসব বিষয়ের শিক্ষকরা বলে দিয়েছেন, যারা কোচিং করবে না তারা ব্যবহারিকে ভালো নাম্বার পাবে না। ফলে বাধ্য হয়েই কোচিংয়ে যেতে হচ্ছে লাবিনকে। শুধু লাবিন নয়, শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যের শিকার এ দেশের বহু ছাত্র-ছাত্রী। আর এই কোচিং ধান্ধার কারণেই শিক্ষকরা ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো পড়া বোঝাতে চান না বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া প্রশ্নফাঁসের মতো অপরাধের সঙ্গে কোচিং সেন্টারগুলোর জড়িত থাকার অভিযোগও নতুন নয়।
নীতিমালা-২০১২ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে বাংলাদেশের সরকার। ২০১২ সালে ওই নীতিমালাটি প্রণীত হলেও আইনি জটিলতায় এতদিন বাস্তবায়ন করা যায়নি। সম্প্রতি সেই জটিলতা কেটে যাওয়ার পর এখন সরকার নীতিমালাটি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে।
এ সম্পর্কে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছেন, ‘নীতিমালাটির বিরুদ্ধে কয়েকজন রিট করায় এতদিন আমরা আইনটির বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এখন সেই বাধা কেটে যাওয়ায় আমরা সেটি বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি।’
সরকার বলছে, নীতিমালাটি সাত বছরের পুরনো বলে সেটি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি কোচিং সেন্টারগুলো নজরদারির কার্যক্রমও শুরু হবে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী জানান, ২০১২ সালে ওই নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয়। এবার আইনি জটিলতা কাটে যাওয়ায় সেটি কঠোরভাবে কার্যকর করতে চলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে গত সাত বছরে কোচিং সেন্টারগুলোর অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাই সেই নীতিমালাটি আরেকটু পর্যালোচনা করে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলো কেবল কোচিং হিসাবেই যেন না থাকে, শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তারা কোচিং বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করারও চেষ্টা করে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে।
তার ভাষায়, ‘পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা অনেক সময় কোচিং থেকে উপকৃত হয়। আবার অনেক সময় অভিযোগ আসে যে, এই সেন্টারগুলোতে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করা হয়। প্রশ্নফাঁস হয় বলেও অভিযোগ পেয়ে এসেছি। এ কারণেই আমরা চেয়েছি যে এখানে একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে হবে।’
শিক্ষা উপমন্ত্রী বলছেন, ‘দীর্ঘদিন মামলা চলার কারণে ওই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখন যেহেতু আইনি বাধা আর নেই, তাই আমরা সেই নীতিমালাটি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। কিন্তু যেহেতু সেটি সাত বছরের পুরনো, তাই বর্তমান বাস্তবতার আলোকে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয় যোগ করতে হবে।’
এ নিয়ে আজ সোমবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বোর্ড, ও বিভিন্ন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
সেখানে কোচিং সেন্টারগুলোর মনিটরিং ও নীতিমালাটি বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হবে। নীতিমালায় বাস্তবায়ন মনিটরিংয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে একটি, জেলা পর্যায়ে একটি ও উপজেলা পর্যায়ে একটি মোট তিনটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল।
মন্ত্রী জানান, এসব সেন্টারকে স্থানীয় সরকারের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী আরো জানান, একজন শিক্ষার্থী কেন কোচিং সেন্টারে যান, সেটাও খতিয়ে দেখবে সরকার। স্কুল কলেজের শিক্ষায় কোন ঘাটতি আছে কিনা, পাঠ্যপুস্তকে সমস্যা আছে কিনা, কেন গাইড বইয়ে শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হয়, ইত্যাদি বিষয়গুলোও তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে এই নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে, সেটি তখন গেজেট আকারে প্রকাশ হয়নি। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর গত ২৪ জানুয়ারি তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়।
ওই নীতিমালায় সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে একজন শিক্ষক তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা কলেজ প্রিন্সিপালের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন।
তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব কোচিং সেন্টারের সঙ্গে তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনোভাবেই যুক্ত হতে পারবেন না। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সরকারি বা এমপিভুক্ত করার ক্ষেত্রে এসব নিয়ম দেখা
বাংলাদেশে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য অবৈধ বলে গত ৭ফেব্রুয়ারি রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে হাইকোর্ট শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২কে বৈধ বলেও ঘোষণা করা হয়েছে। এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা কোচিংয়ে পড়াতে পারবেন না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা