কেমন হবে আগামীর স্মার্ট শিক্ষা
মো. আফজাল হোসেন সারওয়ারঃ ২০৪১ সালে আমরা কেমন শিক্ষাব্যবস্থা দেখব? শিক্ষার্থীরা কি স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স (এআই) কি দখল করে নেবে শিক্ষকদের জায়গা? নাকি শিক্ষার সহায়ক হিসেবে কাজ করবে? স্মার্ট বাংলাদেশের আগামীর শিক্ষার চিত্রায়ন করতে গেলে মনের ক্যানভাসে এই প্রশ্নগুলো ঘুরে ফিরে উঁকি দেয়। গত ১৫ বছরে শিক্ষা খাতে অনেক পরিবর্তন দেখা গেছে। যেখানে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক নির্ভরতা কমে শিক্ষা হয়েছে বৈশি^ক। শহর থেকে গ্রাম, পুরো বিশ্ব এখন চলে এসেছে হাতের মুঠোয়। মুঠোফোনের মাধ্যমে শেখার পরিধি বেড়ে হয়েছে আকাশসম। মুঠোফোন হয়েছে জ্ঞান আহরণের মাধ্যম। কবি সুনির্মল বসু স্বভাবতই বলে গেছেন-‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানাভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’।
আগামীর স্মার্ট শিক্ষাটা হবে তেমনই। শেখার কোনো দেয়াল থাকবে না স্মার্ট বাংলাদেশে। এখানে শিক্ষার্থীরা নিজের সমস্যার সমাধান নিজেই করবেন। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে একজন স্মার্ট নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। সেই শিক্ষা ব্যবস্থায় নাগরিকরা হবেন বুদ্ধিদীপ্ত, দক্ষ, উদ্ভাবনী, সৃজনশীল, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক এবং সমস্যা সমাধানের মানসিকতাসম্পন্ন। তাদের দক্ষতা উন্নয়নে ব্লেন্ডেড শিক্ষা, ডিজিটাল পাঠ্যক্রম, সমাজের সর্বস্তরে ডিজিটাল দক্ষতার উন্নয়ন, স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বৃদ্ধি ও স্মার্ট কর্মসংস্থান অগ্রাধিকার পাবে।
স্মার্ট শিক্ষার লক্ষ্য হবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম ও উদ্ভাবনী একটি তরুণ প্রজন্মকে তৈরি করা। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষাক্রমও করা হচ্ছে যুগোপযোগী। শিক্ষার্থীরা শিখবে হাতে-কলমে, প্রতিনিয়ত সমস্যা সমাধান করার মাধ্যমে। শুধু না বুঝে মুখস্থ করবে না। বরং পড়বে, বুঝবে এবং জীবনের নানা সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে। গড়ে উঠবে বিশ্লেষণনির্ভর মানসিকতা। এই সুযোগ থাকবে শহর থেকে গ্রাম, সবার জন্য। থাকবে আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার সুযোগ। শেখার সুযোগ বৈশি^ক হওয়ায় সব শিক্ষার্থীই নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও দেশ-বিদেশের নানা উৎস থেকে জানার ও শেখার সুযোগ পাবে। স্মার্ট শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির সংমিশ্রণে ব্লেন্ডেড এডুকেশন পদ্ধতিতে শেখা। এটি শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে অনলাইন এবং অফলাইনে শেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ফলে একটি সহজ এবং ব্যক্তি উপযোগী শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হয়।
পারসোনালাইজড শিক্ষা পদ্ধতিতে স্বশিক্ষাকে ও সমস্যা-সমাধানের দক্ষতা অর্জনকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। স্মার্ট শিক্ষার পুরোটাই সাজানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন এবং স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই শিক্ষাক্রমে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পারসোনালাইজড শিখনের ওপর। ফলে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী তার প্রয়োজন, ধারণক্ষমতা, রুচি ও পছন্দ অনুসারে যখন খুশি তখন নিজের সুবিধামতো সময় শিখতে পারবে। একজন শিক্ষার্থী বৈশ্বিক চাহিদাকে মাথায় রেখে নিজেকে দক্ষতাসম্পন্ন করে তুলবে। স্বাবলম্বী হয়ে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করবেন। অন্যদেরও কর্মসংস্থান তৈরির গঠনে। অবদান রাখবেন।
আমরা এমন একটি স্বপ্নকে সামনে রেখে পরিকল্পনা করে যাচ্ছি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা হাতে নিয়েছি মাল্টিমিডিয়া পাঠদান পদ্ধতির মতো উদ্যোগ, যেখানে শুধু পাঠ্যবইকেন্দ্রিক পাঠদান পদ্ধতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা শিখবে না বরং অডিও-ভিজ্যুয়াল কন্টেন্টের মাধ্যমে আরও দৃঢ়ভাবে শিখতে পারবে।
আমরা দেখেছি কোভিড-১৯ অতিমারির সময় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ক্লাসে যেতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়েছিল। হতাশা ও উদ্বেগজনক ওই সময়টিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মভিত্তিক নানা শিক্ষামূলক উদ্যোগ আমাদের শিক্ষাকে চলমান রাখতে সহায়তা করেছে।
গ্রাম ও শহরে প্রত্যেকই সঠিক শিক্ষার আওতায় থাকবেন। সেজন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার ইকোসিস্টেম। যেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষা গ্রহণের জন্যও সহজ ও সুলভ উপায় তৈরি করে দেওয়া হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা গঠনেও সরকার দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা নিয়েছে যেন একজন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীও নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে পারেন। বইয়ের অক্ষরের পাশাপাশি যাতে ছবির কথাও যেন উপলব্ধি করতে পারেন। প্রযুক্তি প্রতিটি শিক্ষার্থীর সহায়ক হবে। মাল্টিমিডিয়া টকিং বইয়ের পাশাপাশি নানা উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাকে সহজলভ্য করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, সবই শেখা নিয়েই বলা হলো, কিন্তু শেখানো নিয়ে তো কিছুই বলা হলো না? একটা কথা আছে না, গুরু বিনে শিষ্য হয় কি করে? মানসম্পন্ন শিক্ষক ছাড়া ভালো মানের শিক্ষার্থী তৈরি অসম্ভব। আর তাই স্মার্ট শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষাক তৈরির ওপরও অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলোকে আরও ভালোভাবে বোঝা ও সমাধানের জন্য শিক্ষকদেরকে প্রযুক্তি ও ডাটানির্ভর পদ্ধতিগুলো ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
এআই কি শিক্ষকদের জায়গা নিয়ে নেবে? না। স্মার্ট শিক্ষক্ষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হতে পারে এআইয়ের প্রয়োগ। শেখানো ও মূল্যায়নে শিক্ষাকেরা এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগাবেন আর শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করবে শেখার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম হবে এআই ব্যবহারে পারদর্শী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে এই প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে।
স্মার্ট শিক্ষাই আমাদের পথ সুগম করে দেবে উন্নত দেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে। সহজলভ্য স্মার্ট ডিভাইস নিশ্চিতের মাধ্যমে শতভাগ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে স্মার্ট প্রযুক্ত। প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা সেবার আওতায় থাকবে দেশের প্রতিটি নাগরিক যেখানে পিছিয়ে থাকবে না কেউই। এটি কোনো রূপকথার গল্প কিংবা অতিকথন নয়। এটি আশা এবং অগ্রগতির আলোকবর্তিকা, যা আমাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে পরিচালিত করছে। যাত্রা শুরু হয়ে গেছে, গন্তব্য অনেক কঠিন তবে অসম্ভব নয়!
লেখকঃ পলিসি এনালিস্ট ও হেড, ফিউচার অব এডুকেশন, এটুআই
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১০/০২/২০২৪