এমপিও নীতিমালায় সহকারী অধ্যাপকদের পদোন্নতির বিষয়টি উপেক্ষিত
মোঃ মঈনুদ্দিন চৌধুরী।।
অনেক জল্পনা-কল্পনার পর অবশেষে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। এতে এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে কর্মরত প্রভাষকগন এমপিওভুক্তির ০৮(আট বছর ) সন্তোষজনক চাকুরি পূর্তিতে প্যাটার্নভুক্ত প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকের মোট পদের ৫০% এই জনবল কাঠামো নির্ধারিত বিভিন্ন সূচকে মোট ১০০ নম্বরের মূল্যায়নের ভিত্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন।
অন্যান্য প্রভাষকগন এমপিওভুক্তির ১০ (দশ) বছর সন্তোষজনক চাকুরি পূর্তিতে জাতীয় বেতন স্কেলের গ্রেড ৯ থেকে ৮ প্রাপ্য হবেন এবং পরবর্তী ৬(ছয়) বছরের মধ্যে অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে এমপিওভুক্তির ১৬(ষোল) বছর সন্তোষজনক চাকুরিপূর্তিতে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাবেন।
সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে মোট ১০০ নম্বরের মূল্যায়ন সূচকের অন্যান্য বিষয়ের সাথে এমফিল/ পিএইচডি ডিগ্রির জন্য ৫নম্বর এবং গবেষনা কর্ম/ স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য ১০ নম্বর রাখা হয়েছে। এমপিও নীতিমালায় প্রভাষকদের পদোন্নতির জন্য মোটামুটি একটা ব্যবস্থা রাখা হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সহকারী অধ্যাপকদের পদোন্নতির জন্য কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
বছরখানেক আগে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির কথা সংস্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন টকশো এর মাধ্যমে নিশ্চয়তা প্রদান করে খুব জোরেশোরে উচ্চারন করেছিলেন, যা শুনে আমরা শিক্ষক সম্প্রদায় খুব ই আশান্বিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, জাতীয় শিক্ষানীতির বিধান মোতাবেক এই বুঝি শুভ সূচনা হচ্ছে।
আমরা আরো ভেবেছিলাম যে, এরই ধারাবাহিকতায় এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজ হয়তো জাতীয় শিক্ষা নীতির বিধান মোতাবেক পরবর্তীতে অধ্যাপক পদ লাভ করে ধন্য হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। অর্থাৎ ২০২১ সালের এমপিও নীতিমালা জারির পর তার সত্যতা কিংবা প্রতিফলন কোনটিই আমরা দেথতে পেলাম না। মোদ্দাকথা, ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপকদের এই স্বপ্নস্বাধ চিরতরে বিলীন হয়ে গেল, ভেঙ্গে চুড়ে খানখান হয়ে গেল সহকারী অধ্যাপকদের পদোন্নতির স্বপ্ন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ২০১০ এর এমপিও নীতিমালায় ডিগ্রি কলেজে সহযোগী অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা হলেও কোন অজানা কিংবা অদৃশ্য কারনে ২০১৮ সালের এমপিও নীতিমালায় তা বাতিল করা হয়। প্রভাষক এর পাশাপাশি বেসরকারি কলেজে অনেক এমফিল/পিএইচডিধারী সহকারী অধ্যাপকও রয়েছেন। কিন্তু তাদের ডিগ্রি ও গবেষনা কর্মকে এই নীতিমালায় সম্পূর্নরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে যাসম্পূর্ন অমানবিক।
অর্থাৎ উচ্চতর ডিগ্রিধারী প্রভাষকদের মূল্যায়ন করা হলেও একই যোগ্যতাসম্পন্ন সহকারী অধ্যাপকদের মূল্যায়ন করা হয়নি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’ কার্যকর করা হয়েছে। অন্যদিকে, ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগের ক্ষেত্রে সহকারী অধ্যাপক এবং উচ্চতর ডিগ্রিধারী এমফিল/পিএইচডিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ রাখা হয়নি।
একটি দেশে যদি উচ্চতর ডিগ্রিধারী এবং উচ্চতর পদের শিক্ষকদের সঠিক মূল্যায়ন করা না হয় কিংবা তাদের হতাশায় নিমজ্জ্বিত করে রাখা হয় তাহলে এর মাধ্যমে কি শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব? আর শিক্ষার মান উন্নয়ন যদি সম্ভব না হয় তাহলে কিভাবে দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে?তাছাড়া ইতিপূর্বে বহুবার আমি উল্লেখ করেছিলাম যে, দীর্ঘ ১২ বছর যাবত ১০% সরাসরি কোটা বন্ধ থাকায় উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকগন পিএসসির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে সরকারি কলেজে উচ্চতর বিভিন্ন পদে নিয়োগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
এর ফলে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরনীয়। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, এমপিও উচ্চতর ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের সরকারি কলেজে যোগদানের এই সুযোগটি বন্ধ করেছিলেন এমপিও শিক্ষকদেরই জাতিভাই বিসিএস সাধারন শিক্ষা সমিতির সম্মানীত সদস্যবৃন্দ। বাংলাদেশে অনেক সময় অনেক অনুৎপাদনশীল খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় কিন্তু দেশের সার্বিক শিক্ষায় ৯৭% অবদান রাখা বেসরকারি শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে কিংবা তাদের পদোন্নতির খাতে বিনিয়োগ করে জাতীয় শিক্ষা নীতির বাস্তবায়ন করলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে তা শিক্ষকদের কাছে বোধগম্য নয়। এমপিও নীতিমালায় সহকারী অধ্যাপকদের অধ্যক্ষ পদে আবেদনের সুযোগ না রাখায় এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ ক্ষেত্রে একদিকে যেমন কোরাম সংকট বা প্রার্থী সংকট দেখা দেবে ( যা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে) অন্যদিকে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হবে।
আর এই সুযোগে এমপিও নীতিমালায় প্রদত্ত বিধান মোতাবেক সরকারি কলেজের শিক্ষকগন এমপিওভুক্ত কলেজে ডেপুটেশনে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ লাভ করবেন। পরিনতিস্বরূপ এমপিওভুক্ত শিক্ষকগন আরো হতাশাগ্রস্ত হয়ে নিজ ঘরেই পরবাসী হয়ে যাবেন। এরূপ অবস্থা নিশ্চয় ই কারো কাম্য হতে পারেনা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যতিত যেখানে বাংলাদেশের সকল প্রতিষ্ঠানের সকল স্তরের কর্মীদের জন্য সুষ্ঠু পদোন্নতির নীতিমালা তথা ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের যথাযথ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে এমপিও শিক্ষকগনের কি সে অধিকার থাকতে পারেনা? এমপিওভুক্ত কলেজে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টিতে যদি গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রনালয়ের অর্থ সংকট দেখা দেয় তাহলে শিক্ষামন্ত্রনালয়ের প্রতি বিনীত অনুরোধ এইযে,সরকার থেকে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই ড্রাই প্রমোশন দিয়ে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে শিক্ষকদেরকে অন্ততপক্ষে সম্মানটুকু প্রদান করুন।
সংস্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ শিক্ষকদের উক্ত পদসমূহের বেতনভাতাদি বহন করবে। আশা করি এ প্রস্তাবে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন জাতীয় শিক্ষা নীতির কৌশল বাস্তবায়ন করে মানবাধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে, অন্যদিকে অর্থমন্ত্রনালয়ের এম পিও শিক্ষকদের পদোন্নতির খাতে অহেতুক বিনিয়োগজনিত টেনশনও দূরীভূত হবে। মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী ও মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় প্রস্তাবটি একটু গভীরভাবে ভেবে দেখবেন কি?
লেখকঃ শিক্ষা বিষয়ক গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, শংকুচাইল ডিগ্রি কলেজ, বুড়িচং, কুমিল্লা।