এই শিক্ষিত মনুষ্য সমাজ লইয়া আমরা কী করিব!
নবনীতা চক্রবর্তী: এমন শিক্ষার সত্যিই প্রয়োজনীয়তা কী? নয়তো মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র আদলে বলতে হয় একেই কি বলে শিক্ষিত মানুষ !!
শিক্ষিত মানুষ যদি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করেন। উগ্রবাদী আচরণ ও জঙ্গিচিন্তার চর্চা করেন। সমাজকে উস্কে দেন সহিংসতার দিকে। মগজ তার ঠাসা থাকে গোড়াঁমিতে। কোন বিষয়ের সঠিক অর্থ ও ব্যাখ্যা করাই সম্ভব না হয় উল্টো ভুল,বানোয়াট, সত্য-মিথ্যা র গোজেঁলে বিকৃত তথ্য উপস্থানের মাধ্যমে সমাজে ক্রমাগত বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকেন তথা নিজেই মগজধোলাইয়ের খেলায় নেমে পড়েন। সুনির্দিষ্ট কোন গোষ্ঠী, শ্রেণি ও লিঙ্গ তার ক্রোধ, আক্রোশ, আক্রমণের শিকার হয়। জীবনাচরণে যদি হয়ে উঠেন কপট, তাহলে শিক্ষা ও শিক্ষিত মানুষ নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
এই শিক্ষিত মনুষ্য সমাজ লইয়া আমরা কী করিব!!!
সম্প্রতি একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন বহিস্কৃত শিক্ষক(!) শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের দুইটি পাতা প্রকাশ্যে ছিড়েঁ ফেলেছেন। শুধু তাই নয় সবাইকে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার আহবান জানিয়েছেন। কি ধরনের মানসিক অবক্ষয় ঘটলে এবং উগ্রবাদের চর্চায় থাকলে এমন আচরণ ঘটাতে পারেন।
সপ্তম শ্রেণির সেই বইয়ে তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক অবস্থান নিয়ে একটি লেখা আছে। এখন বিষয় হচ্ছে,
এই বইয়ে "শরীফ থেকে শরীফার" গল্প ঠিক কি ভুল। সেটা থাকবে কি থাকবে না। সেটা বিকৃত নাকি জনমন স্বীকৃত নাকি শিক্ষাব্যবস্থা রসাতলে যাওয়ার মূলমন্ত্র সেটার আগেও প্রশ্ন উঠতে হবে একজন শিক্ষক কিভাবে এমন প্রকাশ্যে উগ্রবাদী হয়ে উঠতে পারেন? কিভাবে তার ভাষা, তার শারীরিক অভিব্যক্তি, তার বক্তব্য,তার আচরণ সহিংস হয়ে উঠতে পারে? একজন শিক্ষকের আচরণ কেন অসুস্থ , হিংস্র উম্মাদের মতো হবে ?
সহিংস আচরণ কেন প্রশ্নবিদ্ধ হবে না?
সন্ত্রাস কর্মকাণ্ড আর আন্দোলন সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। উল্লেখ্য, সম্প্রতি ও তার কিছু আগেও অগ্নিসংযোগ, অগ্নিসন্ত্রাস সহ মানুষকে হত্যা করার মতো গর্হিত নানান কর্মকান্ডকে আন্দোলনের আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সুকৌশলে মানুষকে ভুল বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
ফিরে আসি আলোচনায় একজন শিক্ষককে অবশ্যই যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত আচরণ করতে হবে। কারণ তিনি শিক্ষক। তিনি চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারেন না।স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দুটো দুই বিষয় ,সেটির সংজ্ঞা তাকে জানতেই হবে । জ্ঞানদানকারী যদি অজ্ঞানের মতো আচরণ করেন তবে তার প্রভাব হয় মারাত্মক যেটির মাশুল দিতে হয় সমাজকে। একজন উগ্রবাদী কিছু উগ্রবাদী অনুসারী তৈরি করবেন। উগ্রবাদের ছায়ায় সুগন্ধি গোলাপের ন্যায় শুভচিন্তার আবাদ হয় না,মারামারি, হানাহানি,হিংসা-প্রতিহিংসা ও আক্রোশের জন্ম হয়।
অন্যদিকে ভিন্নভাবে যদি বলি, বাংলায় সার্বজনীন ও সর্বজনীন দুইটি পৃথক শব্দ আছে। সকলের চেয়ে বয়স্ক অর্থে সার্বজনীন শব্দের ব্যবহার করা হয়,বিপরীতে যাহা সকলের জন্য প্রযোজ্য অর্থে সর্বজনীন শব্দ ব্যবহার করা রীতিসিদ্ধ। ভীষণ পিঠেপিঠি শব্দ। একেবারেই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ এর মতো। এই শব্দ দুটোর ভুল প্রয়োগও হয় অনেক ক্ষেত্রে যেমন সর্বজনীন উৎসব না লিখে সার্বজনীন উৎসব লেখা হয়। এখন এই ভুল শুধরানোর অনেক যৌক্তিক উপায় আছে। পরামর্শ দেওয়া, অন্যদের সাথে আলোচনা করা অন্যান্য বহু যৌক্তিক পন্থা আছে। যদি সেটা না করে যদি সন্ত্রাসের পথে সমাধান খুঁজে তাহলে বুঝতে হবে সমাধানটা তার লক্ষ্য নয় লক্ষ্য হল অন্যকিছু করা। এই ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
সেই অন্যকিছুটা কি সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো। বিভ্রান্ত ও ভুল তথ্যের মাধ্যমে সমাজের মানুষকে উতপ্ত করে তোলা। একটি সহিংস পরিবেশ তৈরী করা। সস্তা ভাইরাল সংস্কৃতির যুগে লোকমুখে জয় আর লোকমুখে ক্ষয় নীতিতে বিশ্বাসী মানুষরা এটিকেই জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে। অথচ যে জনপ্রিয়তা ঠিক দু'টাকার হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, মুখে দিলেই ফাঁকা, শূন্য, অন্তঃসার শূন্য।
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামি, উভকামি, থার্ডজেন্ডার, হিজড়া প্রত্যেকটির অর্থ আছে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে আছে বিভিন্নতা । শব্দের উৎস, অর্থভেদে প্রয়োগ ও যথোপযুক্তি নিয়ে মত -দ্বিমত, অভিমত, তর্ক -বির্তক আছে, থাকবে এবং থাকা উচিত। কারণ একটি সমাজে যার যার মতো করে মতামত থাকবে, চিন্তা থাকবে, সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশও থাকবে। তাই বলে উগ্রতা, সহিংসতা, চিন্তার দৈন্যতা কোনভাবেই কাম্য নয়। উগ্রবাদ, সন্ত্রাস, তথ্যবিকৃতি কোনভাবেই সুস্থ বহিঃপ্রকাশের ভাষা হতে পারে না।
তাহলে, ভিন্ন ধর্মমতের মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, পুলিশ ফাঁড়ি পুড়িয়ে দেওয়া,আগাগোড়া না ভেবে সামাজিক মাধ্যমে এক ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে মানুষকে মেরে ফেলা, শিক্ষকের ঘাড়ে প্রকাশ্যে জুতার মালা চড়ানোর মতো আস্পর্ধা দেখানো গোষ্ঠীর সাথে এই অতিশিক্ষিত শিক্ষকের( প্রশ্নবিদ্ধ) তফাৎ কোথায়!! নাকি এরাই সেই হিংসুক, ধর্মান্ধ উম্মাদের দলের প্রতিভূ যাদের হিংসার লেলিহান শিখায় মুর্হুতেই ভস্ম হয় রামু- রংপুর বা ব্রাক্ষণবাড়িয়া।
পক্ষান্তরে, আমরা একটি বহুত্ববাদী সমাজের কথা চিন্তা করি। যেখানে ধর্ম,বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সম্প্রীতির মনোভাব নিয়ে একসাথে বসবাস করব। যেখানে সবার মত ও দর্শনের গুরুত্ব থাকবে। বর্তমানে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণু হওয়ার প্রবণতা তীব্র। কেউ কারো মত মানতে পারছি না। এমনকি শুনতেও রাজি নই। কারো উন্নয়নে, সফলতায় আমরা অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছি। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক ও বন্ধনের মধ্যে মারাত্মক রকমের শৈথিল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কথাবার্তা, আচার আচরণে আমরা অত্যন্ত মারমুখী ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছি। নিজেদের দ্বায়িত্ব ও অবস্থান ভুলে লিপ্ত হচ্ছি সহিংস কার্যক্রমে। আচরণে আচারি ভুলে যাচ্ছি। বিষয়ভেদে, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাভেদে মতামত, উপলব্ধি ভিন্ন থাকে, থাকতেই পারে কিন্তু তাই বলে এমন আচরণ করা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় যা সমাজে উগ্রতা ছড়ায়।
একই সাথে, সবাই মিলে বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি,সেখানে সব মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে। সমস্ত মানুষের অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষিত হবে। কেউ পিছিয়ে থাকবে না। মর্যাদা সুনিশ্চিত হবে সকল মানুষের। সুনির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর কথা বলা যাবে না এমন কোন আবদ্ধ চিন্তা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সংবিধানে নেই। এই বিষয়টি সহজে ব্যাখ্যা করে আবদুল আল মুহিত "বাংলাদেশ :জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব"বইতে লিখেছেন, "বাঙালি চরিত্র মোটামুটি ধর্ম নিরপেক্ষ। বাঙালি মুসলমান ব্যক্তিগত জীবনে পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি ধার্মিক কিন্তু তারা ধর্মান্ধ নয়। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার তারা অপছন্দ করে।..... বাংলাদেশে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণে যে সমাজ সহস্রাধিক বছরে গড়ে উঠেছে তা বস্তুত পক্ষে সংশ্লেষী নয় বরং যৌগিক সামাজিক এই বৈশিষ্ট্যও হয় জাতীয়তার অন্যতম উপাদান " অর্থাৎ একটি সংমিশ্রণ ও সমন্বয়বাদী সমাজের চালচিত্রর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের উদার, সর্বগ্রাহী এবং সর্বজনীন সমাজে এ ধরনের উগ্র আচরণ কিভাবে এই আধুনিক সময়ে বিস্তার লাভ করছে? সাধারণ মানুষ অবশ্যই এই আচরণ প্রত্যাখ্যান করবেন। বাংলাদেশে ধর্ম সহিষ্ণুতা আছে ।কিছু মানুষ সময়ের সাথে সাথে নিজ স্বার্থ উদ্ধারে ভোল পাল্টে উল্টে দিতে চাইলে তা ধোপে টিকবে না।
২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। শুধু স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্য দিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না সেটার বাস্তবায়ন জরুরি,সেই সাথে জরুরি সমাজে ও রাষ্ট্রে এই হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে নেতিবাচক মনোভাব আছে তা দূর করা। এটাই আমাদের কাম্য। আর সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ করা শুরু করেছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত তারা শিক্ষা বৃত্তির আওতায় আছে, বয়স্করা পাচ্ছেন বিশেষ ভাতা, ৩৮ জেলায় বিভিন্ন ট্রেডে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। প্রশিক্ষণ শেষে আছে অনুদান।
শুধু আইনকানুন দিয়েই সমাজে কারো মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যায় না, সমাজের মূলস্রোতের সাথে সম্পৃক্ত করতে হলে মনমানসিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এই কাজে সসম্পৃক্ত হতে হবে পরিবার ও শিক্ষক তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে, কেননা বৈষম্যের শুরু হয় পরিবার ও স্কুল থেকেই। সুতারাং পাঠ্যসূচিতে "শরীফ - শরীফার গল্প"অত্যন্ত যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয়। যখন আমরা এগিয়ে নেওয়ার কথা বলছি, সমাজে ও রাষ্ট্রে তাদের সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হচ্ছি তখন এই অপপ্রচার, তথ্য বিভ্রান্তি, ঘৃণা, দ্বেষ কেন? কার স্বার্থ হাসিলের জন্য এটা হচ্ছে? ঘৃন্য ষড়যন্ত্রের অশনি সংকেতও বটে।
এই ঘটনা আমাদের কি দেখায়, আমরা কোন সমাজ ব্যবস্থায় বসবাস করছি, যেখানে আমরা কূপমন্ডুক চিন্তাভাবনায় আবদ্ধ। পুরোনো প্রচলিত ধ্যান- ধারণার নিরিখের পাল্লায় আমাদের চোখ সব দেখে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আমাদের শ্রেনি উন্নয়ন তথা জাতি ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে সমন্বয়ভিত্তিক সমাজ গঠনের চিন্তা করছি, ছক কষছি তা বাস্তবায়নের লড়াই তো কেবল শুরু। লড়তে হবে চিন্তার দৈন্যতার সাথে, প্রচলিত ভ্রান্ত প্রথা ও রীতিনীতির সাথে, গুজব ও তথ্য বিকৃতির সাথে অবশ্যই এক উদ্ভাবনী জ্ঞানভিত্তিক,অর্ন্তভুক্তিমূলক, বৈষম্যবিহীন, অসম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের লড়াইয়ে।
সেখানে শিক্ষকরা কোন গোষ্ঠীর পুত্তলিকা হবেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত তাদেরকেই নিতে হবে। দায়বদ্ধতার জায়গাতে কোনপক্ষকে ছাড় দেওয়া উ বিন্দুমাত্র উচিত নয়। তাই যারা এই উগ্রবাদী আচরণকে তোল্লাই দিচ্ছেন, পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন তারা শুধু ভেবে দেখুন বিরোধিতার খাতিরেই বিরোধীতা করছেন কিনা । একটু ভাবুন কাকে, কি কাজের জন্য পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন। দিনশেষে এতে স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে কার? পরিশেষে, "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। "বুদ্ধির মুক্তি ঘটুক। মুক্তি আসুক।
লেখকঃ শিক্ষক, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/৩০/০১/২০২৪