উপাচার্যদের প্রতি খোলা চিঠি
মো. আব্বাস উদ্দিন মোল্লাঃ মহান স্বাধীনতার ৫৪তম শুভেচ্ছা জানবেন। স্বাধীন জাতি হিসেবে ইতিমধ্যে আমরা ৫৩ বছর অতিক্রম করছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি ষাটোর্ধ্ব একজন প্রবীণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৭ বছরের একজন নাবালক ছিলাম। ১৯৮০ সালে এসএসসি পাস করেছি। গণতন্ত্র ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। ১৯৭৫ সালের পরে দেশবাসী মূলত তাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথ হারিয়ে ফেলে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর দেশবাসীর মধ্যে ফিরে আসে গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যাওয়ার আকাক্সক্ষা। ১৯৯১ সালে দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ সংগ্রামে আপনারাসহ দেশের সব পেশাজীবী সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ছাত্র, যুব, মহিলা, কৃষক, শ্রমিক অংশ নিয়েছিল। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের উদ্দেশ্য করে খোলা চিঠি লিখতে হচ্ছে।
আমি একজন অভিভাবক ও রাষ্ট্রের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক। আমাদের দেশে এখন ৫৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলমান আছে; যার মধ্যে ১৮টি সাধারণ, ৫টি মেডিকেল, ৬টি প্রকৌশল, ৭টি কৃষি, ১৫টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ৫টি বিশেষায়িত, ৩টি অফ ক্যাম্পাস বিশ্ববিদ্যালয় আছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত সরকারি ৩৭টি মেডিকেল, ৯টি ডেন্টাল, ৪টি প্রকৌশল, ৮টি টেক্সটাইল ও ২টি ভেটেরিনারি কলেজ আছে। সরকারের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তাবিত আছে এবং আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি চলমান আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আন্তর্জাতিক গ্রেডিংয়ের সূচকে হাজারের মধ্যেও নেই। তবে কারও কারও মতে ৮০০-১০০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যলয়ের নাম আছে মর্মে এক ধরনের প্রচার ও অহঙ্কার পরিলক্ষিত হয়েছে কিন্তু এর তেমন ভিত্তি নেই। অন্তত আমার চোখে পড়েনি।
উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জাতির বিবেক। আপনারা আমাদের বাতিঘর। আমাদের নৈতিকতার পথপ্রদর্শক। সন্তানের এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় পাসের পর প্রত্যেকটি অভিভাবক স্বপ্ন দেখেন তার সন্তানরা যেন কম খরচে রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে দেশ পরিচালনায় যোগ্য নাগরিক হতে পারে। এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা এখন ভর্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত। ২০২০-২০২১ সেশনের আগ পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নানা পদের ইউনিট বা শাখা করে পরীক্ষা নিচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকারের ইচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেষ্টায় দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একত্র হয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। সাধারণ ও বিশেষায়িত শিক্ষার জন্য বড় সম্মিলন গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষিশিক্ষার জন্য গুচ্ছ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল শিক্ষার জন্য গুচ্ছ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল, ডেন্টাল ও নার্সিং শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। বস্ত্র অধিদপ্তর কর্তৃক দেশের টেক্সটাইল কলেজের জন্য নেওয়া হচ্ছে যৌথ পরীক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রফেশনাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও ২/১টি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো গুচ্ছভুক্ত হয়নি। তারা এককভাবে নানাবিধ ইউনিট খুলে সমন্বয়হীনভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে।
ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একমাত্র সফল দৃষ্টান্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য মেডিকেল, ডেন্টাল ও নার্সিং শিক্ষার জন্য গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা। পরীক্ষার্থীরা একই আবেদনে দেশব্যাপী ইচ্ছামতো নিকটতম মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছে। এতে অভিভাবকদের ও শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও খরচ কম হচ্ছে। দ্রুত ফলাফল পাচ্ছে। যে শিক্ষার্থী সুযোগ পাচ্ছে না, সে নতুন করে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের তা সে গুচ্ছ হোক বা একক তারা সমন্বয়হীনভাবে ভর্তি পরীক্ষার আবেদন নেয় এবং ভর্তি পরীক্ষাগুলোও নেয় ‘ইচ্ছা-স্বাধীন’ ভাবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের কলেজগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাধারণত শেষ পছন্দে থাকে। যা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ হারানো শিক্ষার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল। এই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার ভর্তি পরীক্ষা নিতে অপেক্ষা সহ্য হয় না। তারাও সবার সঙ্গেই ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। অথচ শিক্ষার্থীদের তখন মনোযোগ থাকে প্রিয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পছন্দের সাবজেক্টের দিকে। আর ভর্তিযুদ্ধে নামা প্রায় প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী সবকয়টি না হলেও একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে থাকে। ফলে সেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকতে না পারলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে যে ভাবনা-চিন্তা করার দরকার সেই সময় ও মনোযোগ শিক্ষার্থীরা দিতে পারে না।
সাধারণের ধারণা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পড়ছে প্রায় একই সঙ্গে। একই দিনে একাধিক শিফটে পরীক্ষা হয়। শিক্ষার্থীরা কোথায় পরীক্ষা দিয়ে কোথায় যাবে? কখন যাবে? কীসে যাবে? কোথায় থাকবে? আমাদের শ্রদ্ধেয় উপাচার্য মহোদয়রা কি বিষয়টা নিয়ে ভাবেন? তারা কি জানেন ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে পথেঘাটে নিগৃহীত হয়? পত্রিকায় আসছে অনেকে পরীক্ষা দিতে পারছে না বাস, ট্রেন ও লঞ্চের সঙ্গে সময় না মেলানোর জন্য।
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, উপাচার্যরা আপনাদের কি ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ভোগান্তি কমানোর বিষয়ে কিছুই করার নেই? যদি থাকে, তাহলে প্রতি বছর সরকারের র্যাংকিং অনুযায়ী আপনারা পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতো জেলাভিত্তিক কেন্দ্রে ভর্তি পরীক্ষা নিন। ফলাফল দিন। আবার আবেদন নিন। আবার পরীক্ষা নিন। অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি আপনাদের মতো ভর্তিযুদ্ধের ব্যবস্থা করে? আমার জানামতে উচ্চশিক্ষার নামে এমন অপ্রীতিকর অমানবিক অত্যাচার আর কোথাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়। আমরা লজ্জা পাই। আপনারা জাতির বিবেক। আমরা জাতি গঠনে কার কাছে ভরসা রাখব! দুবছর পড়লেখা করে এইচএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পাসের পর শিক্ষার্থীদের ফলাফলকে বিবেচনা করে ভর্তি করানো যাচ্ছে না কেন? ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের লিখিত ও নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নের মান ও পদ্ধতি নিয়েও নানা কথা ওঠে। ক্যালকুলেটর ছাড়া উচ্চতর গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়নের অঙ্কের নৈর্ব্যত্তিক সঠিক ফলাফাল কীভাবে নিরূপণ সম্ভব? আবার ভুল উত্তরে নম্বর কর্তন? আপনাদের এসএসসি ও এইচএসসির পরীক্ষার ফলাফলে আস্থা নেই, আবার আবেদন ও ফলাফল নির্ধারণে আস্থাহীন ফলাফলকে সংযুক্ত করছেন। আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা থাকলে আপনার নিয়মে ১০০ নম্বরের পরীক্ষার ভিত্তিতে মেধা স্কোর তৈরি করতে পারেন।
দেশের আনাচে-কানাচে ছোট-বড় কোচিং সেন্টারে ভরপুর। ভর্তি গাইড, মডেল টেস্ট ইত্যাদি তো আছেই। নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করা শেখানোর হয়রানি তো আছেই, এসব কোচিং, মডেল টেস্ট, গাইড বই সব কিছুতেই খরচ হওয়া টাকার পরিমাণ যে কম নয় আর সেই খরচের বোঝার ভার অভিভাবকদের কাঁধেই পড়ে। আর এসবে আমাদের কোমলমতি ছেলে-মেয়েরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। আর চান্স না পেলে তাদের পড়তে হয় মানসিক বিপর্যয় ও গ্লানির মধ্যে। তারা পারিবারিক ও সামাজিক হেনস্তার শিকার হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অকাল সমাপ্তি হচ্ছে।
মাননীয় উপাচার্য মহোদয়রা ৫৪তম বয়সপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অচেনা ও অবহেলিত দেশ নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো যে প্রক্রিয়ায় উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থী মনোনীত করে আপনারাও আমাদের জনদুর্ভোগ লাঘব করে আগামী ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তির প্রক্রিয়া সংশোধন করুন। মানুষ দেয়ালে ঠেকে গেলে, আর যাবে কোথায়? তেমনিভাবে আমি লাখো অভিভাবকের একজন হয়ে আপনাদের কাছে আমাদের কথা তুলে ধরলাম। আমার চিঠিতে কেউ আহত হলে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করি মাননীয় উপাচার্যদের উদ্যোগ ও সহায়তায় সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা, প্রচার মাধ্যম, পত্র-পত্রিকা, সামাজিক মাধ্যম, ছাত্র সংগঠনসহ সবাই ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মানসিক যন্ত্রণা ও অভিভাবকদের সীমাহীন আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে তৎপর হবেন।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর অভিভাবক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৪/০৩/২০২৪