ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে এমএলএম নয়
নিজস্ব প্রতিনিধি।।
ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে অনেকেই প্রতারণার বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের আড়ালে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণা করে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ, ইভ্যালির বিরুদ্ধে অভিযানের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি একের পর এক অভিযান চলছে। কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে অনেকে কারাগারে রয়েছেন।
আবার অনেকে গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন। শক্ত নজরদারি ছাড়াই একটি দুর্বল কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ই-কমার্সভিত্তিক অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছিল- এটা এখন স্পষ্ট। অফারের ফাঁদ আর লোভে পড়ে লাখ লাখ মানুষ টাকা খুইয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক চিত্র ও ১৯ দফা করণীয় উল্লেখ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এতে বলা হয়েছে, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মকে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে একটি টাস্কফোর্স গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১' নামে নীতিমালা কার্যকর থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এ ক্ষেত্রে 'ডিজিটাল ই-কমার্স অ্যাক্ট' প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ক্রেতা পণ্য বুঝে পাওয়ার পরই মূল্য পরিশোধ করবেন- এটা নিশ্চিত করা জরুরি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে গ্রাহক ও মার্চেন্টদের অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। শুধু ভোক্তা অধিদপ্তরের কাছে ২০ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। আবার অভিযোগের অধিকাংশ রাজধানীকেন্দ্রিক।
মূলত ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে প্রায় ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা মামলার পর ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিষয় বড় আকারে প্রকাশ্যে আসে। গত ১৭ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর গা-ঢাকা দেন প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কর্ণধার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা। পরে তিনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।
এরপর ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে ১৬ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় নিরাপদ ডটকম, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপ, এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস লিমিটেডসহ আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও মালিকদের গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার ভোরে কিউকমের হেড অব সেলস, কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন অফিসার হুমায়ুন কবির নীরব ওরফে আরজে নীরবকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এরই মধ্যে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ই-কমার্সের আড়ালে প্রতারণা ও বিদেশে টাকা পাচারের ব্যাপারে অনেক তথ্য উঠে এসেছে। আরও বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের অভিযোগের বিষয় তদন্ত করে দেখছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
ডিজিটাল ই-কমার্স সেলের প্রধান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আলাদা আইন ও পৃথক কর্তৃপক্ষ তৈরি করতে একটি কমিটি কাজ করছে। সমন্বিতভাবে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। ই-কমার্সের আড়ালে এমএলএম ও জুয়া খেলা যাবে না এটা আমাদের নির্দেশনায় বলেছি।
ই-কমার্সের প্রতারণা নিয়ে তৈরি করা প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ। তিনি সমকালকে বলেন, যেভাবে বর্তমানে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চলছে তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এ খাতে কী করলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রতারণা কমবে, তা উল্লেখ করে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করেছি।
১৯ দফা সুপারিশে যা রয়েছে: পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১-এর নীতিমালা অনুসারে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। চটকদার বিজ্ঞাপনে প্রলোভিত না হয়ে বাজার যাচাই করে পণ্য অর্ডার করে আগে মূল্য পরিশোধের পরিবর্তে ক্যাশ অন ডেলিভারির ব্যবস্থা করতে হবে। পণ্য বুঝে পেয়ে মূল্য পরিশোধ করলে প্রতারণা ও ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলবে। ওয়েবসাইট, মার্কেটপ্লেস, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্য ও সেবা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে এ-সংক্রান্ত সব তথ্য ও শর্ত সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।
কোনোভাবে ডিজিটাল কমার্স বা ই-কমার্সকে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার কাজে ব্যবহার করা যাবে না। ডিজিটাল মাধ্যমে ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। একইভাবে কোনো দাহ্য পদার্থ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রেও নিতে হবে বিস্ম্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স। সরকারের অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের প্রতিষ্ঠান কোনো লটারির আয়োজন করতে পারবে না। বিক্রেতাদের আর্থিক সুবিধায় পণ্য বিক্রির ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রযোজ্য কমিশন ও সরবরাহ চার্জ কেটে রেখে মূল্য পরিশোধের নিয়ম কঠোরভাবে মানতে হবে। পণ্যের পুরো মূল্য পরিশোধ করা হয়ে থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী পাঁচ দিন ও ভিন্ন শহর বা গ্রামে থাকলে ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি দেওয়া বাধ্যতামূলক করা জরুরি।
ক্রেতার কাছ থেকে পণ্যের অর্ডার নেওয়ার আগে তা স্টকে রয়েছে কিনা নিশ্চিত করবে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান আলাদা মনিটরিংয়ের জন্য পৃথক টিম গঠনের কথাও বলা হয়। সারাদেশে ই-কমার্সের নামে 'অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং'-এর দিকে ক্রেতা-বিক্রেতা ঝুঁকে যাচ্ছে কিনা তা নিবিড় পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়। এ ছাড়া সরকার নিয়মিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর অডিট করবে। গ্রাহকের অর্থ যাতে অন্যত্র পাচার না হয়, তা রোধ করতে থাকবে বাড়তি নজরদারি। যেসব ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করা হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তদারকিতে দেশে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করার কথাও বলা হয়েছে। ক্যাশ অন ডেলিভারি চালুসহ টাস্কফোর্স গঠনের প্রয়োজনীয়তা সুপারিশে তুলে ধরা হয়।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কা: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এ প্রতিবেদনে বলা হয়, যারা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রায়ই মিছিল-মিটিং ও সড়ক অবরোধ করছেন। এই ইস্যু ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে এও বলা হয়, প্রতারণামূলক আচরণের কারণে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কমছে।
এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং পলিসির কারণে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রি করায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে পণ্য সরবরাহকারী ও বিক্রেতার কাছে বিপুল অর্থ দেনা থাকছে। এতে বিক্রেতারা বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করার লক্ষ্য নিয়ে বড় ধরনের ডিসকাউন্টের কথা জানিয়ে ভোক্তাদের প্রলুব্ধ করছে। চটকদার অফার দেখে অনেক ভোক্তা বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে, আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে টাকা ধার করে পণ্য অর্ডার করছেন। অনেকে আবার বেশি লাভের আশায় ই-কমার্সকে এমএলএম প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন।
আর্থিক লেনদেন স্থগিত যাদের: আর্থিক দায় ও মূলধনের অস্বাভাবিক পার্থক্য থাকার কারণে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সব আর্থিক লেনদেন স্থগিত করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান হলো- আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জশপ, আলাদীনের প্রদীপ, বুমবুম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস। আর ধামাকা শপিং ১১৭ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দায়ের করা অর্থ পাচার মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।
অভিযোগ বিস্তর: ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে সেগুলো হলো- মনোহর, দালাল প্লাস, কিউকম, পিকাবু, পাবজি, আলাদীনের প্রদীপ, মীনা ক্লিক, বাবুই, ব্যাকপ্যাক, আলি টু বিডি, সেলমার্ট, গ্যাজেট মার্ট, বিডিটিকেটস, সাবু শপ, আমারি, শপআপ, সিরাজগঞ্জশপ, কমপ্লেক্স ডটকম, রাজারহাট, বিডিশপ, চাহিদা ইশপ, আনন্দের বাজার, বুমবুম, ইভ্যালি, দারাজ, সহজ, আজকের ডিল, ফুডপান্ডা, চালডাল, প্রিয়শপ, ফাল্কগ্দুনী, অথবা উবার, পাঠাও, বিক্রয়, নিরাপদ, ই-অরেঞ্জ, রকমারি, ধামাকা শপিং, আদিয়ান মার্ট ও আলেশা মার্ট।
৫ মামলা ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে: এখন পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে। ১ আগস্ট ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি মামলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, মাসুকুর রহমান, আমানু, বীথি আক্তার, কাওসারসহ আরও কয়েকজনকে মামলায় আসামি করা হয়। গুলশান থানায় ৭ ও ১৩ আগস্ট দণ্ডবিধিতে আরও দুটি মামলা হয় একই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া কুমিল্লায় আদালতে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে করা একটি মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। শিল্পাঞ্চল থানায়ও একটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অন্যতম আসামি পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানাকে ভারত থেকে দেশে ফেরাতে তিন দফায় চিঠি দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
অভিযোগের মাত্র ১৬ শতাংশ নিষ্পত্তি ইভ্যালির: পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে ইভ্যালি নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, ইভ্যালির সিইও স্ত্রীসহ গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দুই মাসে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে দুই হাজার ২০৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে মাত্র ৩০৫টি অভিযোগের নিষ্পত্তি করে প্রতিষ্ঠানটি। এ হিসাবে মোট অভিযোগের মাত্র ১৬ শতাংশ তারা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হয়। বাকি ৮৪ শতাংশ অভিযোগের ব্যাপারে তারা কোনো সুরাহা বা কর্ণপাত করেনি। এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছে।