‘আনন্দময় পড়াশোনা’ ও কিছু কথা
এ এন রাশেদা।।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা সংক্রান্ত মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে যা তুলে ধরেন, তার মর্মকথা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। ‘যা কিছু নতুন’ শিরোনামে একটি সংবাদমাধ্যম পয়েন্ট আকারে বলছে- ২০২৩ সাল থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে চালু হবে নতুন পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষা পদ্ধতি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে না কোনো পরীক্ষা। পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ। এসএসসি পরীক্ষা হবে শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে। নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাজন থাকছে না।
একাদশ ও দ্বাদশে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা উপস্থাপন করা হলে তা তিনি অনুমোদন করেন। ২০২৫ সাল থেকে এ শিক্ষাক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছর থেকে কাজ শুরু হবে। আগামী বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন শিক্ষাক্রমের পাইলটিং শুরু হবে। ২০২৩ সাল থেকে ধাপে ধাপে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।’
পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা সম্পর্কে বলেন, ‘অষ্টম ও প্রাথমিকে পাবলিক পরীক্ষার কথা বলিনি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না এবং প্রতিটিতে সমাপনী পরীক্ষা হবে। সনদ দেওয়ার জন্য পাবলিক পরীক্ষার দরকার নেই। পিইসি এখনও ক্লাস সমাপনী পরীক্ষা। জেএসসি পাবলিক পরীক্ষা, বছর শেষে প্রতি ক্লাসে মূল্যায়ন হবে। দশম, একাদশ ও দ্বাদশে পাবলিক পরীক্ষার কথা বলেছিএ এইচএসসির পরীক্ষার রেজাল্ট হবে একাদশ ও দ্বাদশ মিলিয়ে।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন,নতুন শিক্ষাক্রমের বৈশিষ্ট্য হবে ‘শিশুর জন্য আনন্দময় পড়াশোনা।’ সে কথা তো সবাই বলেন এবং মনেপ্রাণে কামনা করেন। বাস্তবে কি তা ঘটে? একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। ১৯৮৩ সালে অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং অন্যদের দ্বারা প্রস্তুতকৃত জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি ‘বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী শিক্ষা’ হঠাৎ বাতিল করে বহুমুখী নীতি প্রবর্তন করা হলো এবং ৬০০ পৃষ্ঠার বই ৩ মাসে সম্পাদন করে প্রকাশের পর দেশব্যাপী প্রতিবাদের ঝড় উঠল।
বিজ্ঞানের বই রচিত হয়েছিল ‘এসো নিজে করি’ দিয়ে। প্রথমে শুনে মনে হবে, ভালোই তো; শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে কাজ করে শিখবে। কিন্তু সব শুভ উদ্যোগ তো প্রথমেই নস্যাৎ হয়ে যায়- যোগ্য-দক্ষ শিক্ষক, সহজবোধ্য বই এবং ব্যবহারিক ক্লাসের অভাব যদি ঘটে। তা-ই ঘটেছিল। সে বইগুলো রচিত হয়েছিল প্রথমে ইংরেজিতে। বিদেশিরা দেখার পর তা আবার বাংলায় করা হয়েছিল। কথাগুলো বলেছিলেন তৎকালীন সচিব ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীন। আর ‘এসো নিজে করি’র মধ্যে কোনো সমাধান দেওয়া হতো না। ব্যাখ্যা বা বর্ণনা বা ক্লু কোথাও থাকত না। তাহলে শিক্ষার্থীরা জানবে কীভাবে?
এসব প্রশ্নের উত্তরের চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে- বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান যেনতেন একটি প্রকল্প তৈরি করে বিরাট অঙ্কের ঋণ দিতে চেয়েছে; আর অমনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে ওই প্রকল্প গ্রহণ করেছেন কর্তাব্যক্তিরা। তাই, এতে লাভের চাইতে ক্ষতি হয়েছে বেশি। ঠিক একইভাবে বিশ্বব্যাংকের বুদ্ধিতে জোর করে শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়া ছাড়া হাজারো প্রশংসা গেয়ে ২০০৮ সালে মাধ্যমিক স্তরে চালু করা হয়েছিল পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি। সৃজনশীল পদ্ধতি যে সৃজনশীল না- এ বিষয়ে বহু লেখালেখি হয়েছে।
পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে প্রশ্ন যাই করুক না কেন, সৃজনশীলতার ৪ নম্বর অংশে পাতা ভরে সারাংশ লিখে দেওয়ার বুদ্ধি শিক্ষকরাই দিয়ে দিতেন। পরীক্ষকদেরও নির্দেশ দেওয়া হতো শিক্ষার্থীকে মার্কস দিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ২০১৫ সালে বাদ সাধল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। সে বছর এসএসসিতে গণিতের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র। কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে ওই বিষয়ে শিক্ষকস্বল্পতা এবং সৃজনশীল পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষকদের পরিচিত না করার কথা। আবার সব শিক্ষকের ধারণক্ষমতা এক না। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহী করে তুলতে সব রকম ব্যবস্থাপনাই দরকার। সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর সময় বলা হয়েছিল- প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, দক্ষ ও যোগ্য এক দল শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাবে, কিন্তু সেটা হয়নি।
সৃজনশীল পদ্ধতির ১০ বছর পার হলেও শিক্ষক-শিক্ষার্থী অর্ধেক সংখ্যকের বেশি এখনও ‘সৃজনশীল’ ঠিকমতো বোঝেন না। ১০ বছরেও অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের আওতায় আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এখন তারা স্বপ্ন দেখছে ‘আনন্দময় পড়াশোনা’র। পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে শিক্ষাকে বের করে এনে পরীক্ষার পরিবর্তে শ্রেণিকক্ষে ‘দক্ষতাভিত্তিক ধারাবাহিক মূল্যায়ন’ চালু করার কথা। সেখানে প্রতি বিষয়ে পূর্ণমান ১০০ নম্বর থাকলেও চূড়ান্ত পরীক্ষার বিষয় ও শ্রেণিভেদে ৪০ থেকে ৫০ নম্বরের পরীক্ষা নেওয়া হবে। বাকি নম্বরের শিখন মূল্যায়ন করবেন শ্রেণি শিক্ষকরা। নতুন এ পদ্ধতি চালুর জন্য খোলনলচে বদলে ফেলা হবে বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে ইত্যাদি।
এখানেই মন্তব্য করতে চাই- ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ ১০ বছরেও শিক্ষকদের আত্মস্থ হয়নি। আর ‘আনন্দময় পড়াশোনা’র জন্য এই মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ব্যবস্থাতে শিক্ষকরা এত অল্প সময়ে ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়নে কীভাবে দক্ষ হয়ে উঠবেন? এও কি সম্ভব? প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা কত কোটি টাকার প্রজেক্ট? এই নতুন প্রজেক্টের ফলে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালুর জন্য খরচ হওয়া ৮০০ কোটি টাকা পানিতে যাবে। অভিজ্ঞতা এ কথাই বলে।
২০০৪ সালে নেওয়া হয়েছিল একমুখী শিক্ষাক্রম। এর বাজেট ছিল পাঁচশ কোটি টাকা। ওই একমুখী শিক্ষার জন্য কনসালট্যান্টদের ফি বাবদ খরচ ৩৬ কোটি টাকা। ২৬৭ জন শিক্ষা কর্মকর্তার ৪টি দেশের একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা সরেজমিন দেখা বাবদ খরচ হয়েছিল ৩২ কোটি টাকা। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বাথরুম ও নলকূপ বাবদ খরচ ১৩৩ কোটি টাকা। ছাত্রী উপবৃত্তির নামে ১৮০ কোটি টাকা।
প্রকল্পের আসবাব ও যানবাহন খরচ ২২ কোটি টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হয়েছে ৫৮ কোটি টাকা। প্রতিবেদন তৈরি, শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন, কর্মী খাতে প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে ১৬ কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাতে ২১ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্প থেকে সার্ভিস চার্জ পাবে ১২ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকা বাংলাদেশের কোনো উপকারে আসুক বা না আসুক; ঋণদাতাদের একদিকে সুদ হিসেবে লাভ, আবার সার্ভিস চার্জ হিসেবেও লাভ হয়েছে।
এ টাকা খরচ করতে পারলেই সরকারি কর্মকর্তা, আমলা, মন্ত্রীদের দারুণ শান্তি। তাই ওপর থেকে মাঝেমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয় টাকা খরচের। টাকা খরচ না হয়ে চলে গেলে ডিসক্রেডিট হয় কর্মকর্তার। তাই যেনতেন প্রকারে তা খরচ হয়।
১৯৮৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত শিক্ষায় নানা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করা হয়েছে। কিন্তু সুফল মেলেনি। কী করলে সুফল মিলবে? সহজ কথায় বলা যায়- শিক্ষকের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দিতে হবে এবং দিতে হবে সর্বোচ্চ সম্মান। তাহলে মেধাবীরা এ পেশায় আসবেন। ক্লাসে শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাত ১ : ২০ হতে হবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের জন্য এবং ১ :৩০ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। এলাকার শিশুরা এলাকায় পড়বে। প্রতিটি স্কুলকে সমান সুযোগ দিতে হবে। আকর্ষণীয় করতে হবে।
প্রকল্পের মধ্য দিয়ে উন্নয়ন কিন্তু না। কারণ, যার মধ্য দিয়ে প্রথমে আসে গাড়ি, যা রাস্তায় বাড়ায় যানজট, পরিবেশের করে ক্ষতি। শুধু শিক্ষকের সম্মানজনক বেতন তো না, দিতে হবে সব পেশার সব মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা। সমাজের সবার কথা, যেমন কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম, শ্রমিকের ভালোভাবে বেঁচে থাকার মজুরি। শুধু আমলা-মন্ত্রী-এমপি ও ধনিকদের কথা ভাবলে সমাজে অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতি- কোনো কিছুই কমবে না।
‘আনন্দময় লেখাপড়া’র সুযোগ সৃষ্টি করতে চাইলে শিক্ষাব্যবস্থাসহ সমাজের সব ব্যবস্থার কথাই ভাবতে হবে। নইলে ১৯৮৩ সালের ‘এসো নিজে করি’ তথাকথিত ‘একমুখী শিক্ষা’ ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’র যে-দশা হয়েছে, সে দশাই হবে। চটকদার, সুন্দর, আদর্শবাদী কথা জনগণ কিছুদিন শুনবে, অনেকের পকেট ভরবে। রাস্তায় এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকরা অনশন করতেই থাকবেন। শ্রেণিকক্ষের লেখাপড়ার মান যা আছে তাই থাকবে বা আরও নিম্নগামী হবে।
লেখক- সম্পাদক, সাপ্তাহিক একতা