আড়াই হাজার বছর আগে যেভানে চালু হয় ভোটপ্রথা
ঢাকাঃ আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন ঘিরে গত ক’দিন কত কী-ই না হলো! আসলে দুনিয়াজুড়েই ভোটকে ঘিরে এমন বাহাস, তর্ক-বিতর্ক হয়। উত্তেজনা ছড়ায়। কম-বেশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। আবার এই ভোটকে ঘিরে হয় অন্যরকম এক উৎসবও। দেশে দেশে বড় এবং ঐতিহাসিক অনেক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু ঠিক কবে থেকে ভোট দিচ্ছে মানুষ? কোথায়, কীভাবে এই ভোটপ্রথা চালু হয়েছিল? জানার ইচ্ছে হয়েছে কখনো? আসুন তাহলে ইতিহাসটা একবার জেনে নেওয়ার চেষ্টা করি।
না, ভোটপ্রথা শুরুর নির্দিষ্ট কোনো দিন, ক্ষণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কোন প্রেক্ষিতে, কীভাবে চালু হয়েছিল ভোটপ্রথা, সে সম্পর্কেও নিশ্চিত তথ্য নেই কারও কাছে। তবে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য আহরণ করা গেছে, সেসবের ভিত্তিতে ধারণা করা হয়- পৃথিবীতে মানুষের ভোটদানের ইতিহাস কয়েক হাজার বছর পুরনো। প্রাচীন গ্রিক এবং প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে ভোটপ্রথা প্রচলিত ছিল। ছিল যে, তার অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণও মিলেছে।
প্রাচীন গ্রিসে আনুমানিক ৫০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে গণতন্ত্রের প্রাথমিক রূপটি দৃশ্যমান হতে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তখন ভোট দেওয়া হতো অজনপ্রিয় নেতা নির্বাচনের জন্য। পুরুষ জমির মালিকরাই শুধু ভোট দেয়ার অধিকার রাখতেন। প্রার্থীদের মধ্যে যিনি বেশি ভোট পেতেন তাকে গলায় মালা দেয়ার জন্য কাউকে পাওয়া যেত না। উল্টো বেশি ভোট পাওয়ায় পরবর্তী দশ বছরের জন্য তাকে নির্বাসনে যেতে হতো! গ্রিক সাম্রাজ্যে ছিল ভোটার তালিকাও। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৫-৫২৪ অব্দে গ্রিক শাসক ছিলেন ‘ক্লিসথেনিস।’
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে তার শাসনামলের দুর্লভ ভোটার তালিকা পাওয়া গেছে। সে সময় ব্রোঞ্জের পাতে ভোটারদের নাম খোদাই করা থাকত। গবেষণা বলছে, প্রাচীন এথেনিয়ান ডেমোক্রেসির সিটি স্টেট নির্বাচনে এ ভোটার তালিকা ব্যবহার করা হয়। তখনো সবাই ভোট দিতে পারতেন না। সর্বজনীন ছিল না ভোট। এলিট ক্লাস বা উচ্চ শ্রেণির পুরুষরা ভোট দেয়ার উপযুক্ত বলে গণ্য হতেন। এ ক্ষেত্রেও শর্ত দেওয়া থাকত- যাদের সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে তারাই কেবল ভোট দিতে পারতেন। সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া ব্যক্তিদের বিশেষ তালিকা করা হতো।
সে তালিকাই কাজ করত ভোটার তালিকা হিসেবে। ভোটদানের প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় রোমেও। প্রাচীন রোমে ১৩৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের ভোটার তালিকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভোটের মাধ্যমেই নেতা নির্বাচন করতো রোমের অধিবাসীরা। উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ধারণা মজবুত হতে থাকে সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুতে। তারও পরে চালু হয় ভোটদান প্রথা।
এদিকে, ভোটাধিকার চর্চা বা গণতন্ত্র চর্চায় যারা মোটামুটি এগিয়ে ছিল তারাও প্রাথমিক পর্যায়ে, এমনকি তারও অনেক পর পর্যন্ত নারীদের ভোটার করেনি।
পুরুষশাসিত সমাজ নারীকে ভোটাধিকারের যোগ্য মনে করা হত না। আজকের অনেক উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রও দীর্ঘকাল নারীর ভোটের অধিকার অস্বীকার করেছে। ভোটাধিকার পেতে নারীকে প্রতিবাদী হতে হয়েছে। আন্দোলন করতে হয়েছে। ভোটসংক্রান্ত প্রাচীন তথ্য বলছে, ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার প্রাপ্ত হন নারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে নারীরা প্রথম ভোটার হন ১৯২০ সালে।
আমাদের এই উপমহাদেশে যে ভোটপ্রথা চালু হয়েছিল, সেটাও অনেককাল আগে। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারাই ঠিক করতেন কে হবেন তাদের রাজা। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তাল পাতায় লিখে রাখা হতো ভোটারের নাম। তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা জনপদ বা গ্রামসভার নির্বাচনে ভোট প্রদান করতেন। বৈদিক যুগে বৈশালী গণরাজ্যে ভোটের মাধ্যমে ‘গণপতি’ নির্বাচন করা হতো।
বাংলায় ৭৫০ থেকে ৭৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল। তিনিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা নিরসনে ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রকৃতিপুঞ্জ বা বাংলার প্রধান নাগরিকরা গোপাল নামের সামন্ত এই নেতাকে বাংলার রাজপদে নির্বাচিত করেন।
আর ভারতবর্ষে নারীদের ভোটার করার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯১৭ সালের দিকে। ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাস মতে, ওই বছর ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হন ব্রিটিশ নারী অ্যানি বেসান্ত। তিনিই উদ্যোগী হয়ে আইন সংশোধন করেন। কয়েক বছর পর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ ভারতে ইমপারিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ইলেকশন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত হয় প্রোভেন্সিয়াল কাউন্সিল ইলেকশনও। দুই নির্বাচন সামনে রেখে একাধিক প্রদেশে ভোটাধিকার প্রদান করা হয় নারীদের।
সেদিক থেকে দেখলে, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে প্রায় একই সময়ে নারীরা ভোট দিতে শুরু করেন ভারতে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৪ সালে প্রথম ভোটার রেজিস্ট্রেশন করা হয়। গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-১৯৩৫ এর আওতায় চূড়ান্ত করা হয় ভোটার তালিকা। এতে নারীদের ব্যাপকহারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে ভোট দেন তারা। অপর এক তথ্য অনুযায়ী, সে সময় পূর্ব বাংলার ভোটার তালিকায় মোট এক কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৫৬৩ জনের নাম ছিল। তাদের মধ্যে ৯২ লাখ ৩৯ হাজার ৭২০ জন ছিলেন নারী।
বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাক্কালে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তার আগে পাকিস্তানের সংবিধানের আওতায় সম্পন্ন করা হয় ভোটার রেজিস্ট্রেশনের কাজ। এ নির্বাচনেও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এবং এই নির্বাচনেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ। কিন্তু বাঙালির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি না হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এতে সর্বজনীন ভোটাধিকার নীতি অনুসরণ করা হয়, যা আজও চলমান আছে।
আজ ৭ জানুয়ারি রবিবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠুন। এতক্ষণ যে ভোট ও গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস বর্ণনা করা বলা হলো, ভোট দিয়ে সে ইতিহাসটিকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। এটা অপনার নাগরিক দায়িত্ব।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/০১/২০২৪