অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা আর কবে
ঢাকাঃ দেশের বর্তমান জাতীয় শিক্ষানীতি সংসদে পাস হয় ২০১০ সালের ৭ ডিসেম্বর। এ শিক্ষানীতির অন্যতম মৌলিক বিষয় হলো প্রাথমিক শিক্ষাস্তর হবে পঞ্চম শ্রেণির পরিবর্তে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ কার্যক্রম শুরু করে ২০১৮ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে তা বাস্তবায়নের কথা ছিল। এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এটি বাস্তবায়িত হয়নি।
জাতীয় শিক্ষানীতির ওই সিদ্ধান্ত আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা, সেটাও এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। কারণ, চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এ শিক্ষাক্রমে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘প্রাথমিক স্তর’ ধারণাটি পুরোপুরি বাদ রয়েছে এবং এতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘নিম্নমাধ্যমিক স্তর’ ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় শিক্ষানীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক সিদ্ধান্ত এক যুগেও বাস্তবায়ন হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর করার কোনো কার্যক্রমই আর চালু নেই। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষা বর্তমানে মাধ্যমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম– এই তিন শ্রেণির শিক্ষাব্যবস্থা ও দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিলে তারা সেটি পরিচালনা করতে পারছে না।
সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, এ তিন শ্রেণির দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বুঝিয়ে দিতে আগ্রহী নয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নিতে এ মুহূর্তে খুব একটা ইচ্ছুক নয়। কারণ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকট রয়েছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্যও পর্যাপ্ত সময় দরকার। জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী কেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না– এ প্রশ্নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, জাতীয় শিক্ষানীতি সংশোধন হবে। তারপর যা করার, তা করা হবে।’ এদিকে, কিছুদিন ধরে জাতীয় শিক্ষানীতি সংশোধনে উদ্যোগের কথা জানাচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। সময়ের সঙ্গে অনেক বিষয় পরিবর্তন হওয়ায় এ উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘প্রায় ১২ বছর আগে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন সময় এসেছে শিক্ষানীতি সংশোধন, পরিমার্জন ও সংযোজন করার।’
শিক্ষানীতি সংসদে পাস হওয়ার পর ২০১১ সালের ২৮ জুন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে আহ্বায়ক করে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন ও মনিটরিং কেন্দ্রীয় কমিটি’ গঠন করা হয়। এ কমিটির অধীনে বেশ কয়েকটি উপকমিটি হয়, কিন্তু এখন সেসব কমিটির অস্তিত্ব নেই। শিক্ষানীতিতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর করার সুপারিশ ছিল। এ ছাড়া, মাধ্যমিক স্তরের তিন ধারা অর্থাৎ সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষায় কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক রাখা এবং বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চতর গণিত বাধ্যতামূলক করতে বলা হয়েছিল। এসব পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত হয়নি।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে বাধা কোথায় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে নিতে সরকারের আর্থিক বিষয় জড়িত। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত তিনটি নতুন শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করতে হবে। নতুন শিক্ষকও নিয়োগ দিতে হবে। তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এসব কাজে বিপুল অর্থ প্রয়োজন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে নিতে কয়েক দফা উদ্যোগ নিয়েও অর্থের অভাবে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০১৩ সালে পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিটি উপজেলা ও থানায় একটি করে মোট ৫১৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়। ২০১৪ সালে এসব বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিও চালু করা হয়। একই বছর এসব বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী ছিল ১৮ হাজার ৯৩৩ জন। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষে এসব বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু হয়। এর বাইরে ২০১৪ সালে নতুন করে ১৭৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি চালু করা হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল দু’জন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ওইসব বিদ্যালয়ে নিম্নমাধ্যমিক স্তর ভালোভাবে চলেনি। আর এখন সেসব বিদ্যালয় থেকেই শিক্ষার্থীদের নিম্নমাধ্যমিকে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিদ্যালয়গুলোতে উপযোগী শ্রেণিকক্ষ নেই, ছাত্রীদের আলাদা কমনরুম নেই। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের বসার ব্যবস্থা নেই। নিম্নমাধ্যমিক স্তরে পড়ানোর জন্য বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের পদও নেই। তা ছাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যায়, প্রাথমিকে সেই সুযোগ নেই। প্রাথমিক শিক্ষকদের নিম্নমাধ্যমিক স্তরে পড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষকরাও বলছেন, অবকাঠামোগত সংকট নিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে নিতে আরেকটি বড় বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য একটি নতুন পাঠ্যক্রম প্রণয়ন। কিন্তু দুই স্তরের পাঠ্যক্রমে সেতু রচনা হবে নাকি ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠক্রম পরিবর্তন করা হবে, সে সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি।
সম্প্রসারিত প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যক্রম তৈরিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবিতে) একটি কমিটি রয়েছে। এ কমিটির অভিমত হলো দুই স্তরের শিক্ষাকে এক স্তরে নিতে হলে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রম ও সব পাঠ্যপুস্তক নতুন করে তৈরি করতে হবে।
তা ছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক। আর ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বেতন দিয়ে স্কুলে পড়ে। এ তিন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া যদি অবৈতনিক হয়, তাহলে যে অর্থের প্রয়োজন হবে, সেই বরাদ্দ শিক্ষা খাতে থাকবে কিনা; সেটাও এখন পর্যন্ত অজানা।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে নিতে আর যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে, তা হলো শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি হবে কীভাবে? কোন মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি দেবে? এসব বিষয় সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কী বলছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্বে থাকা মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা পরীক্ষামূলকভাবে ৭০০ থেকে ৮০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি চালু করেছিলাম। আসলে অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত না করে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব নয়।’ দেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিটি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষ মাত্র চার-পাঁচটি, কিন্তু দরকার কমপক্ষে ছয়টি। সঙ্গে শিক্ষকদের একটি রুমও দরকার।’
মো. মোশাররফ হোসেন জানান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করে দেয় এলজিইডি, অর্থ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সক্ষমতা ও জনবল ঘাটতির কারণে এলজিইডি বছরে ২০ হাজারের বেশি শ্রেণিকক্ষ তৈরি করে দিতে পারে না। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রধান ও চারজন সহকারী শিক্ষক থাকার কথা, কিন্তু সবখানে তা নেই। আরও শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। এ প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় এক বছর লাগে।’
তবে প্রাথমিকে শিক্ষক ঘাটতি কাটাতে ৩৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিকে ‘আশা জাগানিয়া’ হিসেবে দেখছেন মো. মোশাররফ হোসেন। ওই শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ মেয়াদ ১৮ মাস থেকে কমিয়ে আট মাস করা হয়েছে এবং তাঁদের অনেকে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান শুরু করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের চেষ্টায় ত্রুটি নেই।’ সূত্র; সমকাল
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৫/০৭/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়