আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, শিক্ষক। একসময় শিক্ষকতা পেশায় আসতেন, শহর বা গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ। তাদের শিক্ষা, চিন্তা এবং মানবিকতায় গড়ে তোলা হতো একের পর এক প্রজন্ম। সেই তারাই আজ বাংলাদেশের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে।
‘শিক্ষা’ বিনয় দান করে এটা প্রকৃত অর্থেই আমরা জানি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে অথবা অত্যন্ত সচেতনভাবেই প্রাইমারি শিক্ষকদের আর্থিকভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ গোড়াতেই হাত দিয়েছেন। তারা জানেন, সেখান থেকেই যদি শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তুষ্টি তৈরি করা যায় তাহলে কোনোভাবেই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত প্রজন্ম গড়ে উঠবে না। একইসঙ্গে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর দেশ আগামীর বাংলাদেশের চেহারাও খুব একটা আকর্ষণীয় বা মনোমুগ্ধকর হবে না। যে কারণে, সব ফেলে রেখে একমাত্র সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। ডিগ্রি এক কিন্তু বেতন আলাদা। কেন? এই কেনর উত্তর তাদের জানা, যারা শীতল কক্ষে বসে এদের-তাদের বঞ্চনার জন্য কূটকৌশল আঁটেন। না হলে, স্নাতক পাসের যোগ্যতা থাকার পরও কেন শুধু শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে অন্যরকম বৈষম্য নিয়ে আসা হয়েছে? যদিও একই যোগ্যতা নিয়ে ভিন্ন পেশার মানুষ, ওপরের গ্রেডে শিক্ষকদের চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন।
জানা যাচ্ছে সরকারি কোনো চাকরিতে, স্নাতক বা সমমান চাওয়া হলেও তাদের পদমর্যাদা সাধারণত দ্বিতীয় শ্রেণির। তারা ১০ম বা ১১তম গ্রেডে বেতন পান। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষকদের ক্ষেত্রে হচ্ছেটা কী? তারা পাচ্ছেন ১৩তম গ্রেডে বেতন! দীর্ঘদিন থেকে এই বৈষম্য চলে এলেও কোনো সরকারই এর সমাধান করেনি। যে কারণে এখনো তাদের বেতন-ভাতা তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর গ্রেড অনুযায়ী! এর ফলে সরকারি সহকারী শিক্ষকদের মনে ক্ষোভ তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করতে হলে অনেকেরই গ্রেড উন্নীতের প্রয়োজন পড়বে। কারণ প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদা পেলেও তারা এখনো ১১তম গ্রেডে বেতন পান। সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত করে ১০ম গ্রেডে আনতে হলে প্রধান শিক্ষকদের বেতন গ্রেডও উন্নীত করতে হবে।
কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের বক্তব্য অবাক করা। তিনি বলেছেন অন্য যেসব স্নাতক পাসের চাকরিতে ১০ম গ্রেড দেওয়া হচ্ছে, তারা সংখ্যায় খুব কম। যারা সরকারি প্রাথমিকে আসছেন, তারা জেনেশুনেই ১৩তম গ্রেডের চাকরিতে আসছেন। তবে সরকারের সক্ষমতা বাড়লে শিক্ষকদেরও বেতন-ভাতা বাড়বে।
কী চমৎকার যুক্তি! মোদ্দা কথা হচ্ছে, যেভাবে আছে সেভাবেই থাকুক! সহকারী শিক্ষকদের নিয়ে এত চিন্তা করার কী আছে? চাকরি করলে তারা করবে, না করলে নাই। এই ধরনের মানসিকতা নিয়ে, যারা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের আসল উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করা উচিত। কিন্তু করবে কে? সেই তো তারাই! ফলে যা হচ্ছে, তাই হবে। মনে রাখা দরকার, এভাবে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে উপহাস করা, প্রকারান্তরে নিজের পায়েই কুড়াল মারার নামান্তর। শিক্ষকদের জীবনমানের উন্নতি না হলে বর্তমান বাজারমূল্যের সঙ্গে পরিবার-পরিজন নিয়ে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব।
এইভাবে চলতে থাকলে মেধাবীরা কখনো এই পেশায় আসবেন না। আর মেধাবীরা না এলে শিক্ষা এবং শিক্ষাগ্রহীতার মান কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, চলমান সমস্যা সমাধান করে, শিক্ষকদের বৈষম্য থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। শিক্ষকদের দাবি আহামরি কিছু না। এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জরুরি ভিত্তিতে একটি সমাধানে আসা উচিত। ভুলে যাওয়া অন্যায় হবে এই শিক্ষকই কিন্তু আলোকিত-সভ্য-সুন্দর জীবনের প্রথম প্রেরণা।