শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ সম্প্রতি স্যার সম্বোধন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। রংপুরের জেলা প্রশাসককে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের স্যার বলা না বলা নিয়ে শুরু হয় বিতর্কের। বিতর্কে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক জানান, তারা শিক্ষার্থীদের স্যার সম্বোধনে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাদের মধ্যে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আর রাজী গতকাল তার ফেসবুকে লিখেছেন:
‘১. আত্মীয়তা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের বাইরে আমাকে যে বা যারা “তুমি” বলে, আমি তাদের প্রকাশ্যে “আপনি” বললেও মনে মনে “তুই” সম্বোধন করে তার নিকুচি করি।
২. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এই নিয়তে হইছিল যে, এইখানে সকল মানুষ সমান তথা সমমর্যাদার। কেউ কারও চেয়ে কোনো উসিলাতেই এক চুল বড় বা ছোট না। কোনো আচার-আচরণ-সম্বোধনে কাউকে অধিক সম্মানিত করে তোলার বা সম্মান কম দেখানোর সুযোগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান রাখেনি।
৩. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সরকারে কোনো “কর্মকর্তা” নাই। সংবিধানে “কর্মকর্তা” বলে কাউকে নির্দেশ করা হয়নি। রাষ্ট্রের আছে কেবল নানান পদের “কর্মচারী”। যারা নিজেদের কর্মকর্তা পরিচয় দেন তাদের একদল স্রেফ বাটপার আর অন্য দল সংবিধান লঙ্ঘনকারী।
৪. বাংলাদেশে অসভ্য লোকজন তৈরির মূল কারখানা সম্ভবত, এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষক নিজেদের মাস্টার বা প্রভূ জানেন আর শিক্ষার্থীদের নির্বিশেষে “তুমি” বলে সম্বোধন করেন। এই বিকারের চরম প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন প্রশ্নপত্রে। “তুমি কী মনে কর” বা “তোমার মতামত দাও/যুক্তি দাও” ইত্যাদি বাক্যাংশ হচ্ছে সেই অসভ্যতার প্রমাণ।
৫. আমার শিক্ষার্থীদের আমি আমাকে “স্যার” সম্বোধন করতে নিরুৎসাহিত করি এবং আমাকে দেখামাত্র তড়াক করে দাঁড়িয়ে যাওয়া যে শিক্ষার্থীদের “অভ্যাস দোষমাত্র” তা স্মরণ করিয়ে দেই। আর যেসব শিক্ষার্থী তাদের “তুমি” সম্বোধন করতে আমাকে অনুরোধ করেন, আমি তাদের আমাকেও “তুমি” ডাকার অনুরোধ করি।’
একই বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকার ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক আজ তার ফেসবুকে লিখেছেন:
‘কাকে ‘স্যার’ বলা যাবে অথবা আদৌ কাউকে স্যার সম্বোধন করা সমীচীন কিনা, এ নিয়ে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কদিন ধরে চলছে তুলকালাম। মূল ধারার কিছু গণমাধ্যমে কিছু মন্তব্য-কলামও চোখে পড়ল। কোথাও কোথাও দেখলাম জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন ‘সরকারি কর্মকর্তারা স্যার বা ম্যাডাম নয়, শিক্ষকরাই কেবল স্যার ও ম্যাডাম’।
শিক্ষকরাই কেবল স্যার বা ম্যাডাম—এ বিষয়ে আমার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি। অনেকে একমত নাও হতে পারেন, কেননা এ স্বাধীনতা তাদের আছে। একইভাবে আমারও আছে সেই স্বাধীনতা।
আমি ১৯৮২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করি। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ‘স্যার’ অভিধাটি আমার কাছে ঔপনিবেশিক অভিধা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। ১৯৮২ সাল থেকে অন্তত ২০ বছর আমার অসংখ্য শিক্ষার্থী আমাকে ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করেছেন। বলা যেতে পারে আমি তাদের দাদা বলতে বাধ্য করেছি। আমি নিশ্চিত, এই পোস্ট দেখার পর আমার ওই সময়ের প্রিয় ছাত্ররা এই সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন।
সব থেকে বড় কথা, যারা আমাকে দাদা বলেছেন, আমার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা অনেকের চেয়ে বেশি বলেই মনে হয়েছে। এবং এখনও তা অটুট আছে।
ছাত্রাবস্থায় আমাদের বিভাগের পিয়ন, যাকে আমি ভাই বলে সম্বোধন করেছি, শিক্ষক হবার পর, এমন কি ২০০৩ সালে আমি যখন বিভাগে সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি তখনও সেই পিয়নকে ভাই বলেই সম্বোধন করেছি। তিনি আপত্তি করলেও শুনিনি। আমি দেখেছি এতে আমার প্রতি তার ভালোবাসা ও কর্তব্যবোধ আরও প্রগাঢ় হয়েছে। তিনি একদিন চোখের জল ফেলে এমন কথাও বলেছেন: আগের অনেক সভাপতি তাকে দিয়ে তাদের জুতো বহন করিয়েছেন।
আজ চারদিকের নানামুখী অভিঘাতে আমাকেও ‘স্যার’ সম্বোধন গিলতে হচ্ছে। কিন্তু ভেতরে গেঁথে আছে অতীতের সেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যৌক্তিক মধুর স্মৃতি, যা আমি এখনও অন্তরে ধারণ করি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্তরাষ্ট্রের বার্ড কলেজের এক্সপেরিমেন্টাল হিউম্যানিটিজ বিভাগের ভিজিটিং অধ্যাপক ফাহমিদুল হক তার ফেসবুকে লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষার্থীরা আর আমাকে স্যার ডাকে না। ডাকে প্রফেসর হক। কেউ কেউ ইমেইলে লেখে ‘হাই ফাহমিদ’। আবার ড্রাইভিংয়ে ভুল করলে কোত্থেকে পুলিশের গাড়ি উদয় হয়, গাড়ি রাস্তার পাশে নিয়ে বলে, শো মি ইয়োর ড্রাইভার্স লাইসেন্স, স্যার। সব উল্টাপাল্টা! যে ইংরেজরা স্যার ডাকা শেখালো, তারা নিজেরাও আর আগের মতো স্যার-টার ডাকে না। প্রেমিকা বা বউ কখনো ডাকে নি, কিন্তু অচেনা মেয়েরা যে কতবার ‘হানি’ ডাকলো!
হ্যাঁ, দাম পরিশোধের সময় কোনো কোনো সেলসগার্ল বলে, হ্যাভ আ নাইস ডে, হানি। প্রথমবার এই ডাক শুনে ভড়কে গেছিলাম।
ডাকাডাকি নিয়ে এত সিরিয়াস হবার কিছু নাই। জবরদস্তি তো করাই যাবে না। দেখেছি, দেশের আমলাদের মধ্যে এ নিয়ে কম্পলেক্স বেশি। সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদরা এবিষয়ে উদার। তাদের ভাই ডাকাই দস্তুর। শিক্ষকদের এই সমস্যা নাই, সবাই তাদের স্যার ডাকে। তবে প্রফেসর অমুক ডাকা শুরু করলে কি দাঁড়ায় কে জানে! ‘হাই রহমান/আহাম্মদ/ইসলাম’ বলে ইমেইল করলে তো কম্পিউটারটাই বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে।’
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৪/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়