শিক্ষাবার্তা ডেস্ক, ঢাকাঃ মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ। এ অবস্থায় টেস্ট পরীক্ষায় মেয়েটি চার বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। এ কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করা থেকে বিরত রাখে। এতে মেয়েটি আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তার মা-বাবা স্কুল কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা কোনো ফল পাচ্ছিলেন না। অবশেষে তাঁরা শিশুদের সহায়তায় স্থাপিত ‘১০৯৮’ নম্বরে ফোন দেন। এখান থেকে নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘প্রতিবন্ধী’ হিসেবে মেয়েটিকে ফরম পূরণের সুযোগ দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ।
রাজধানীর দনিয়ার বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে মেয়েটি। স্কুল কর্তৃপক্ষের অনীহার মুখে মা-বাবার প্রায় দুই মাসের ‘দৌড়ঝাঁপের’ পর মেয়েটি ১৪ মার্চ তার এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে সক্ষম হয়। এতে পরিবারটির মধ্যে স্বস্তি এসেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ভুইয়া আবদুর রহমান বলেন, বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, টেস্টে চার বিষয়ে অকৃতকার্য কাউকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া যায় না। এমন একজনকে সুযোগ দিলে অন্যরাও তা দাবি করবে। এ বিবেচনায় প্রথমে মেয়েটিকে ফরম পূরণ করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পরে ‘প্রতিবন্ধী’ বিবেচনায় তাকে ফরম পূরণ করতে দেওয়া হয়েছে।
করোনাকালে ওসিডি
পরিবারটি জানায়, মেয়েটি চতুর্থ শ্রেণি থেকে বর্ণমালা আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা হানা দেয়। মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময় অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। তখন মেয়েটি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে সে তাল হারায়। পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে। পাশাপাশি তার মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়।
মেয়েটির বাবা বলেন, ‘আমরা ২০২০ সালে করোনাকালে প্রথম মেয়ের মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি বুঝতে পারি। আমাদের মেয়ে এমনিতে খুব শান্ত। কিন্তু তখন তাকে পড়তে বললে সে ভীষণ রেগে যেত। নিজে থেকে না চাইলে তাকে তখন পড়তে বসানো যাচ্ছিল না। পরে আমরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই। চিকিৎসক জানান, মেয়ের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। সে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডারে (ওসিডি) ভুগছে। সেই থেকে তার চিকিৎসা চলছে।’
ওসিডি বা চিন্তাবাতিক একটি উদ্বেগজনিত মানসিক রোগ। এ ক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবনা ও ভয় থেকে আচরণগত অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। ভুল ও অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা ব্যক্তিকে তাড়িত করে বেড়ায়, যা ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সাধারণত শৈশব ও কৈশোরে রোগটি শুরু হয়।
শ্রেণিকক্ষ বিচ্ছিন্ন
মেয়েটির মা বলেন, পরীক্ষার ফল খারাপ হতে থাকলে সে (মেয়ে) স্কুলে একধরনের মানসিক পীড়নের মুখে পড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি স্কুলের শিক্ষকদের মেয়ের অসুস্থতার বিষয়টি জানান। এতে উল্টো ফল হয়। তাঁর মেয়েকে অন্যদের থেকে আলাদা করে বসানো হয়। ফলে মেয়েটি ক্লাসের ভেতরে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গত বছর ‘টেস্ট’ পরীক্ষায় অংশ নেয় মেয়েটি। পরীক্ষায় সে চার বিষয়ে অকৃতকার্য হয়। ১৮ ডিসেম্বর এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ শুরু হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ফরম পূরণ করা থেকে বিরত রাখে।
জরিমানা ছাড়া ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত ফরম পূরণের সুযোগ পায় শিক্ষার্থীরা। ১০০ টাকা বিলম্ব ফি দিয়ে ৭ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সে সময় প্রথম দফায় ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ফরম পূরণের সময় বাড়ানো হয়েছিল।
ফরম পূরণে আকুলতা
মেয়েটির মা বলেন, ফরম পূরণের সময় শেষ হওয়ার আগে তাঁরা শ্রেণিশিক্ষক, অধ্যক্ষ ও স্কুল কমিটির সভাপতির কাছে একাধিকবার গিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষে ফরম পূরণ না করতে দেওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিল। এ নিয়ে তাঁদের অপমানসূচক মন্তব্যও শুনতে হয়েছে। শিক্ষক এমনও বলেছেন, ‘আপনার মেয়েকে স্কুলে আসতে মানা করেছি। কেন এখনো স্কুলে পাঠাচ্ছেন?’ প্রতিবার বাড়ি ফিরলে মেয়ে আকুল হয়ে বলত, ‘আমি কি পরীক্ষা দিতে পারব না?’
চাইল্ড হেল্পলাইনে ফোন
স্কুল কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে না পেরে মেয়েটির বাবা গত ২৩ জানুয়ারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত চাইল্ড হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ নম্বরে ফোন করে সহায়তা চান।
টোল ফ্রি এ সেবার সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন বলেন, কল পাওয়ার পর তাঁরা একাধিকবার স্কুল কর্তৃপক্ষ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। মেয়েটির মানসিক স্বাস্থ্যগত অবস্থার কথা জানিয়ে তাঁদের ব্যবস্থা নিতে তাঁরা অনুরোধ করেন।
অবশেষে ফরম পূরণ
ডেমরা থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হারুণ-অর-রশীদ বলেন, স্কুলগুলো সাধারণত পাবলিক পরীক্ষায় সার্বিক ফল খারাপ হতে পারে—এমন ভাবনা থেকে টেস্টে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের ফরম পূরণ করতে দেয় না। মেয়েটির অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তাকে যেন ফরম পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়, সে জন্য তাঁরা স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন। ফরম পূরণের সময় বাড়িয়েছিল বোর্ড। সে অনুযায়ী, ফরম পূরণের শেষ দিন ছিল ১৪ মার্চ। স্কুল কর্তৃপক্ষকে আবার নির্দেশ দেওয়ার পর তারা সেদিন ফরম পূরণের ব্যবস্থা করে।
মেয়েটির মা জানান, ১৪ মার্চ স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁর মেয়েকে ডেকেছিল। যাওয়ার পর তাকে ফরম পূরণ করতে বলা হয়। সে ফরম পূরণ করে। তবে কাগজপত্রে মেয়েকে ‘প্রতিবন্ধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
চাইল্ড হেল্পলাইনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর (২১ মার্চ পর্যন্ত) স্কুল-সম্পর্কিত সমস্যা জানিয়ে এখানে ৯১২টি ফোন এসেছে। আগের বছর একই বিষয়ে ফোন আসে ৫ হাজার ৮৫৬টি। এ ছাড়া গত বছর নির্যাতন, আইনি বিষয়, প্রেমের সম্পর্ক, মানসিক সমস্যা, শারীরিক সমস্যা, তথ্য চাওয়া, মজা করে কল, অন্যান্য বিষয়সহ মোট কল আসে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৬১টি। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই ছিল তথ্যের সহায়তা চেয়ে কল।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৯/০৩/২০২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা, ক্যারিয়ার সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়