গ্রেড পয়েন্ট কীভাবে হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক।।
জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমানের যে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে- তাতে সবাই পাস করলেও কে কোন গ্রেড পয়েন্ট পাবে তার রূপরেখা এখনো প্রণয়ন করতে পারেনি শিক্ষা বোর্ডগুলো। চলতি অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে মূল্যায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত হতে পারে বলে জানা গেছে। এরপর নভেম্বরে ফলাফল প্রস্তুত করে ডিসেম্বরে প্রকাশ করা হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অটো পাসের ফলে নানা অঙ্ক কষছে শিক্ষার্থীরা। সবচেয়ে বেশি খুশি যাদের আগের দুটি পরীক্ষাতেই জিপিএ ৫ রয়েছে। যাদের কোনো একটি পরীক্ষার ফল খারাপ, তারা মূল্যায়ন ফলাফলের পাশাপাশি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে রয়েছে দুশ্চিন্তায়। সব শিক্ষার্থী পাস করায় নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়া নিয়ে ভর্তিচ্ছুদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে। এবার সারাদেশে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থী ছিল। এদের সঙ্গে মহাদুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাদের বাবা-মা। সব মিলিয়ে শুধু এইচএসসি ও সমমানে প্রায় ২৭ লাখ মানুষ পরীক্ষাসংক্রান্ত অস্বস্তিতে রয়েছেন। তাদের একটাই প্রশ্ন- গড় মূল্যায়নে গ্রেড পয়েন্ট কিভাবে হবে এবং কত হবে?
শিক্ষা বোর্ডগুলো বলছে, যেভাবে জেএসসি ও এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে মূল্যায়নে কথা বলা হয়েছে, বিষয়টি অতটা সহজ নয়। পুরো প্রক্রিয়াটিই জটিল। গত কয়েক দিন ধরে মূল্যায়নের জটিল পদ্ধতি নিয়ে নানা রকম তত্ত¡ হাজির করা হচ্ছে। কিন্তু কোনোটাই কাজে আসছে না। এ রকম পরিস্থিতিতে মূল্যায়ন করতে কি কি সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা চিহ্নিত করার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের নির্দেশ দিয়েছে স্ব-স্ব শিক্ষা বোর্ড। চিহ্নিত হওয়া সমস্যাগুলো নিয়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোর সিস্টেম এনালিস্ট কমিটি, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি এবং চেয়ারম্যানস কমিটি বৈঠকে বসবে। পরে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সভা হবে। সেই সভার সিদ্ধান্ত মূল্যায়নসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির কাছে জমা দেয়া হবে।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং মূল্যায়নসংক্রান্ত বিষয়ে গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, বিষয়গুলো নিয়ে বলার কিছু নেই। সহজ করে দেখলে সহজ, কঠিন করে দেখলে কঠিন। আমরা যেটাই করি না কেন, তা পরীক্ষার্থীদের পক্ষে যাবে। কিন্তু
জটিল এই প্রক্রিয়া সমাধানের রূপরেখা কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কাজ করছি। কাজ শেষ হলে ফলাফল দেয়া হবে। ফলাফল প্রকাশের পর আপনারা (সাংবাদিকরা) বিশ্লেষণ করবেন। আগেভাগে বিশ্লেষণ করলে বিভ্রান্তি বাড়ে বলে মত দিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেএসসি এবং এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফলাফল নির্ধারণ করা হবে। অনেকেই প্রশ্ন রেখে বলেছেন, জেএসসি-জেডিসিতে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টিই নেই। কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসিতে পদার্থবিজ্ঞান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই বিষয়ের মূল্যায়ন কি করে হবে? হয়তো কোনো শিক্ষার্থী কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে জেএসসি পরীক্ষা ও যশোর বোর্ড থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে; পরে তার সিলেট শিক্ষা বোর্ড থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিলÑ এ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর মূল্যায়নের জন্য তিনটি বোর্ডের সমন্বয় হবে কি করে? কোনো শিক্ষার্থী হয়তো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে। সেই শিক্ষার্থী জেএসসি পড়েনি। এ ক্ষেত্রে ওই শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন কিভাবে হবে? মূলত, এই প্রশ্নসহ আরো কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। কিন্তু এখনো সমাধানের সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে বিভাগ পরিবর্তনকারীদের মূল্যায়নে যে জটিলতা দেখা দেবে তা নিরসনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে। সেই কমিটির প্রধান হয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক-১) নাজমুল হক খান। কমিটি এখনো কাজ শুরু করেনি।
এবারের এইচএসসি ও সমমানে যারা পরীক্ষা দিচ্ছে তারা ২০১৬ সালে জেএসসি এবং ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। ২০১৬ সালে জেএসসিতে ২১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭৫ জন পাস করেছিল। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৪৭ হাজার ৫৮৮ জন। ওই বছরের জেএসসি উত্তীর্ণরাই ২০১৮ সালে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। পাস করে ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১০৪ জন। জিপিএ ৫ পেয়েছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন। এসএসসি উত্তীর্ণরা একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় এবং এদের মধ্যে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন চলতি বছর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ ভয়ে এখন আর তাদের পরীক্ষাই হবে না। জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন হবে। দুই পরীক্ষার ভিত্তিতে এইচএসসিতে মূল্যায়ন করা হলে জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যা কত হবে। এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট প্রকৌশলী মো. মনজুরুল কবীর লেন, মূল্যায়নে সবাই পাস করবে এটা ঠিক, কিন্তু কে কোন গ্রেড পাবে তা এখনো নির্দিষ্ট হয়নি। গ্রেড পয়েন্টের হিসাব কিভাবে সে বিষয়ে কয়েক দিন ধরে নানা তত্ত¡ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। হয়তো গ্রেড পয়েন্টের বিষয়টি চূড়ান্ত করতে এ সপ্তাহ লেগে যাবে।
অভিভাবকরা বলছেন, আগের দুই পরীক্ষার ফলের গড়ের মাধ্যমে এইচএসসির ফল নির্ধারণে আরো বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলে এসএসসি ও এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বরের একটি অংশের গড় থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচএসসির প্রাপ্ত নম্বরের ৬০ শতাংশ এবং এসএসসির ৪০ শতাংশ নেয়া হয়েছে। কোথাও এইচএসসির ৩০ বা ২৫ শতাংশ আর এসএসসির যথাক্রমে ১০ ও ১৫ শতাংশ নেয়া হয়ে থাকে। অন্যদিকে বুয়েটসহ ইঞ্জিনিয়ারিং বা মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত ও জীববিদ্যার বিষয়ে গ্রেড নির্ধারণ করে দেয়া হয়। স্নাতকে সম্মান পড়তে বিষয়ভিত্তিক প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনা করা হয়। এসএসসির তুলনায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি স্তরে উল্লিখিত বিষয়ে বেশ গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, গড় নম্বর বা গ্রেড দেয়া হলে কেউ অতি মূল্যায়িত হবে আবার কেউ অবমূল্যায়িত হবে। এতে কেউ কেউ বঞ্চিত হতে পারে। তবে শিক্ষা বোর্ডগুলো হতাশার কথা বলছে না। তারা বলছে ঠিকঠাক মূল্যায়ন করতে আমাদের কষ্ট হবে।
জানতে চাইলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাধব চন্দ্র রুদ্র বলেন, মনে হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে আমরা হোঁচট খেতে পারি। তবে কোন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের গ্রেড পয়েন্ট দেয়া হবে তা জানতে আমাদের সমন্বিত বৈঠক পর্যন্ত আপেক্ষা করতে হবে। বৈঠকের আগে কিছু বলা ঠিক হবে না।
বোর্ডসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, যে শিক্ষার্থীরা জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল তারা এইচএসসিতেও জিপিএ ৫ পাবে। কেউ জেএসসিতে জিপিএ ৫ কিন্তু এসএসসিতে জিপিএ ৪ পয়েন্ট ৫০ পেয়ে থাকলে গড় মূল্যায়নে সেই শিক্ষার্থী এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাবে না। ঠিক এখানেই বহু শিক্ষার্থী আপত্তি জানিয়ে বলেছে, পরীক্ষা হলে হয়তো এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পাবে। এখন মূল্যায়নের খপ্পরে পড়ে তাদের উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎই নষ্ট হয়ে গেল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানায়, জেএসসিতে তার ভালো ফলাফল ছিল। এসএসসিতে শারীরিক সমস্যায় ফলাফল ভালো হয়নি। এইচএসসিতে ভালো ফলাফলের জন্য গত দুবছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করেছি। কিন্তু এই পরিশ্রম পণ্ড শ্রমে পরিণত হয়েছে। গড় মূল্যায়নে এইচএসসিতে আমার ফলাফল ভালো হবে না। আর ফলাফল ভালো না হওয়ায় আমি ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারব না।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. সামসুল ইসলাম বলেন, খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিরূপণ করার জন্য প্রত্যেক শিক্ষা বোর্ডে দুটো কমিটি কাজ করছে। সিস্টেম এনালিস্ট কমিটি এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি। আগামী ২২ অক্টোবরের মধ্যে কমিটি দুটোর প্রতিবেদন চেয়ারম্যানস কমিটিতে পাঠানো হবে। সেই কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মূল্যায়ন নীতিমালা প্রণয়ন হবে। এরপর নীতিমালা মেনে ফলাফল প্রকাশ করা হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে গড় মূল্যায়নের সিদ্ধান্তে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর পাশাপাশি জটিলতা দেখা দিয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি (বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বা বিএম) শিক্ষার্থীদের ফল নির্ধারণ করা নিয়ে। এ পরীক্ষায় প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দুটি সরাসরি বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম বর্ষের ফল এরই মধ্যে প্রকাশিত হলেও দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাহলে এই শিক্ষার্থীদের ফল কি শুধু প্রথম বর্ষের ফলের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হবে, নাকি তাদের দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা বোর্ডের অধীনে নেয়া হবে- তা নিশ্চিত নয়। এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।ভোরের কাগজ