আমরা কি নষ্ট সমাজে পৌছে গেছি ?
এ এইচ এম সায়েদুজ্জামান।।
ত্বাত্তিকভাবে বলতে গেলে সমাজ হল একটি সংঘ বদ্ধ গোষ্ঠি যাদের কৃষ্টি কালচার এক রকমের হয়। কিন্তু মূল কথা হল, সমাজ সৃষ্টি হয় মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য। আত্নীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবার জন্য। জীবনে চলার পথ সহজ করার জন্য। তাই যারা সভ্য মানুষ তারা সামাজিকতার বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায়।
তারপর ও সমাজকে আমরা কখনো কখনো নষ্ট সমাজ, ঘুনে ধরা সমাজ বলে থাকি। যে সমাজের কাছে মানুষ নিরাপত্তা চায়। ন্যায্য অধিকার ফিরে পেতে সহযোগিতা চায়, সে সমাজে যখন তা থেকে সে বঞ্চিত হয় তখনই তার নিকট তা নষ্ট সমাজ। তাহলে আমরা কি নষ্ট সমাজে পৌছে গেছি ? কারণ প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ অস্থিরতায় কাটছে ।
হিংসা বিদ্বেষ অসত্য আর ধ্বংসের খবরে আকীর্ণ থাকছে দৈনিক পত্রিকা-গণমাধ্যম। অবিবেচনা, অবিবেচক এবং অবিচারের মস্ত এক পাথর যেন বসে আছে সমাজ এবং জাতির মনোজগতে। ইতিহাসে বিভ্রান্তি, ভূগোলে আবিলতা আর ধারাপাতে ছন্দপতনই যেন এখনকার রীতি হয়ে উঠে আসছে। সর্বত্রই বিশ্বাসহীনতা, সমাজ-সংসারকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দেশ এবং জাতির হৃদয়ে অশান্তির দাবানল। এই দহন-জ্বালার বিস্তার ঘটছে প্রতিনিয়ত।
সারা বিশ্বজুড়েই যেন এমন দৃশ্য এমন হা হুতাশ। যত ধীরলয়েই হোক নীতি-নৈতিকতা বর্তমানে নিম্নগামী। নিম্নগামী সভ্যতার পারদ। বিভক্তি এখন সব এলাকায়; কি দেশ কি জাতি, কি সমাজ কি পরিবারে। এই বিভাজনই অস্থিরতাকে করছে প্রলম্বিত। অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন হচ্ছে জাতি-দেশ।
সমাজে বাড়ছে হতাশা, হানাহানি, পরিবারে বাড়ছে কলহ- যার তিক্ততায় দেশে বাড়ছে বিসংবাদ-দুর্নীতি-দুর্ভাবনা। কেবল দেশ-জাতি ধ্বংসের অনুষঙ্গই এসব উপলক্ষ নয়, সভ্যতা ধ্বংসের উপাদানও এই লক্ষণগুলো। এই দেশ এই জাতিও যেন এমনি একটি ক্রান্তিকালে এসে উপনীত হয়েছে।
সময় যাচ্ছে দ্রুত। স্বাধীনতার প্রায় আটচল্লিশ বছর অতিক্রম করল জাতি। আটচল্লিশ বছর একটি দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়েও কলহ মিটল না। অবসান ঘটল না বিভেদ-বিদ্বেষের । সার্বিক বিবেচনায় এ দিকটির প্রতি দৃষ্টি দিলেও দেখা যাবে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। জাতি হাবুডাবু খাচ্ছে এমনি এক বিতিকিচ্ছি কুয়াশায়।
প্রতিদিনের পত্রিকাগুলোতে থাকছে ধ্বংসের খবর, অশান্তির খবর, বিভেদের খবর। যে সব খবর হিংসা-বিদ্বেষকেই উচকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিবেক বিবেচনার তোয়াক্কা করছে না কেউ। যে জন্যে স্থিতি আসছে না কোন প্রান্তেই। পৃথিবীতে এমনও দেশ দেখা গেছে স্বাধীনতার দশ-বিশ বছরেই শিরদাড়া শক্ত করে দাঁড়িয়ে গেছে। এর নেপথ্য কারণ বিবেক-বিবেচনা আর দেশপ্রেম।
মনে হচ্ছে ডিমেনশিয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত সমগ্র জাতি। কি শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, সব একবরাবর। উপশমের কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে এ ব্যাধি। এই ডিমেনশিয়া ব্যাধিতে আক্রান্ত জাতির তাই আটচল্লিশ বছরেও বালকসুলভ আচরণকে অতিক্রম করতে পারল না।
পত্রিকায় চোখ রাখলেই কেবল ধ্বংসের খবর। হিংসা-বিদ্বেষের শ্রেণীবিন্যাস। পৃষ্ঠাজুড়ে থাকছে অশান্তি আর অসত্যের উগলানো বয়ান। কোথাও আশার বাণী নেই। স্বস্তিদায়ক কোন চিন্তা-ভাবনা যেন ভুলতে বসেছে সবাই। চ্যানেলগুলোতেও দৃশ্যায়িত হচ্ছে জাতিবিধ্বংসী চিত্রাবলি দেশ-বৈরী কথকতা। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়।
থাকতেও পারে। আছেও, তবে তা খুবই নগণ্য, মাইক্রোস্কোপিক। তাই জাতি ভুগছে আশাহীনতায়, উদ্দেশ্যহীনতায়। শোভন চিন্তায় দেশপ্রেমে নিজেদের যুক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। হিংসা-বিদ্বেষ আর অসত্যের ডামাডোল এতটাই উচ্চনিনাদে বহমান যে, পরিবেশে ভিন্ন কিছু-চিন্তা করার অবকাশই থাকছে না।
অপভাবনার নেপথ্যে পড়ে থাকছে শোভন ব্যবহার, চিন্তা-চেতনার ইতিহাস-ভূগোল। সুশীল সমাজের সুভাবনার মাঠটি এখন আগাছায় ভরপুর। এই আগাছা উৎখাতের কোন উদ্যোগ নেই। উৎসাহও যেন ফুরিয়ে গেছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতাও একপ্রকার নিঃশেষের পথে। যে কারণে সমাজে অসত্য-অশান্তির জয়জয়কার-উল্লাস। নষ্ট সমাজে কষ্ট যেমন বৃদ্ধি পায়, ভ্রষ্টদের উৎপাতও বাড়ে পাল্লা দিয়ে।
এই ভ্রষ্টতার বিস্তারে আতঙ্কিত সুনাগরিকগণ-নিরীহ জনতা। যে দেশের সুশাসনের ঘাটতি দেখা দেয় সেই মাটিতেই জন্ম নেয় ভ্রষ্ট চরিত্র, ভ্রষ্ট ধ্যান-ধারণা। এ রকমেরই একটি ভ্রষ্টতায় আটকে গেছে দেশ, জাতির বিবেক-বিবেচনা।
দেশের বিদগ্ধজনরা যখন বিভ্রাটে নিপতিত হয় তখনি আমজনতার অস্থিরতা বাড়ে। মাছের পচন নাকি শুরু হয় মগজ থেকে। এই বঙ্গদেশেও সুশীল আর কুশীল একাকার। উন্মাদের আচরণ প্রতিটি প্রান্তেই। সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও বিভাজন, দ্বন্দ্ব, দস্যুতা। সুশীল সমাজও আর সুশীল থাকছে না। দ্বন্দ্ব শেষাবধি মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আটচল্লিশ বছরেও তেমন কোনো অর্জন নেই এই অঙ্গনে, কেবলমাত্র হিংসা-বিদ্বেষের কারণে।
নিষ্ঠুরতাই এখানে একটি বড় ধরনের উপসর্গ। আর একটি কারণ আপন-ভূমির প্রতি মমতার অভাব। অর্থবিত্তের প্রতি প্রচন্ড রকম লোভ লালসা। অন্যায়-অবিচারে এদের শীতলতা। এ সত্যটিকেই যেন আরো স্পষ্ট করে তুলে আনে। যাদের একমাত্র আরাধ্য হওয়া উচিত সমাজ-সংসারের মঙ্গল কামনা। এরাই যখন বিপরীত চিন্তায় বিভোর হয়, স্বার্থ ভাবনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে প্রতিপলে তখনি দেশে নেমে আসে ঘোর অমানিশা।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশকেও যেন সে রকমেরই একটি ভয়ানক অমানিশা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এ থেকে বুঝি উদ্ধারের পথ নেই। হতাশা, শঙ্কা, আশঙ্কাই যেন এ জাতির নিয়তি। বিদগ্ধজনদের ভাবনার জাগরণ এবং সত্যের প্রতি প্রণতিই পরিবেশকে পরিশীলিত করার পথ প্রশস্ত করতে পারে। কিন্তু এমন আশা দূরাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। দুর্ভাবনাকেও তুলে আনছে। এরপরও আশার দিকে হস্ত প্রসারিত রাখাটাই সুবিবেচনা। নষ্ট সমাজে বসতি বা নষ্ট শাসনে আক্রান্ত এমনটা ভাবতে কষ্ট হলেও এ রকম ভাবনা থেকে উদ্ধারের উপায় থাকছে না। চারপাশটায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সেই নষ্টের ভিতরে কষ্টের ঢাক-ঢোল বেজে উঠছে বিকট আওয়াজে। তাই হতাশা আর অস্থিরতা বাড়ছে সমাজে-দেশে।
বর্তমান বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে হযরত আলী (রা.) একটি বাণী। বাণীটি হলো এ রকম- ‘কখন বুঝবে একটি দেশ ও সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে, যখন দেখবে দরিদ্ররা ধৈর্যহারা হয়ে গেছে, ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছে, মূর্খরা মঞ্চে বসে আছে, জ্ঞানীরা পালিয়ে যাচ্ছে এবং শাসকরা মিথ্যা কথা বলছে’।
সবাই বলছে নষ্ট সমাজ, নষ্ট দেশ আর নষ্ট তার মানুষ। আমার কিছুই বলার নেই। নেই কোনো অভিযোগ। "আলহামদুলিল্লাহ" প্রাণে বেঁচে আছি হাজার হাজার শুকরিয়া আল্লাহ্র দরবারে।
লেখক- প্রধান সম্পাদক, শিক্ষাবার্তা ডট কম।