স্কুল-কলেজে গানের শিক্ষক নেই কেন?
লাইসা আহমেদ লিসাঃ সংগীতচর্চা তো বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে আবহমানকাল ধরেই গলা ধরাধরি করে হ্াটছে। তবে আগে ছিল গুরুমংখী শিক্ষা। গুরুরা নিজস্ব উদ্যোগে শিষ্য তৈরি করতেন। কোনো কোনো গুরুর নিজস্ব সংগীতের ধারা ছিল। সেই ধারাকে বাঁচিয়ে রাখা কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এই গুরু-শিষ্য পরম্পরা ছিল। কিন্তু আমাদের এখানে সংস্থার বিষয়টা বেশিদিনের পুরনো নয়। ষাটের দশকের গোড়ার দিকে মূলত সংগীত বা অন্যান্য সংস্কৃতিচর্চাকে সংস্থার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ, তখন সংস্কৃতিচর্চা শুধুই বিনোদন বা সুকুমার বৃত্তির চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
দেশের রাজনৈতিক উত্তাল পরিস্থিতিতে শিল্পকে প্রতিবাদ ও আন্দোলনের হাতিয়ারে পরিণত করে। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী (১৯৬১) পালনের অনুষ্ঠানে যখন রাজনৈতিক বাধা এলো, রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিষিদ্ধ করা হলো, তখন সংস্থার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ধরা দেয়। শিল্পী সমাজ এক হতে ‘ছায়ানট’ গঠিত হয়। সব বাধা উপেক্ষা করে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করল ‘ছায়ানট’। এবং পরবর্তী সময়ে পহেলা বৈশাখ পালন করা শুরু হলো।
‘ছায়ানট’ কিন্তু শুরুতে সংগঠন হিসেবে সূত্রপাত করে, পরে বিদ্যায়তনে রূপ লাভ করে। এটাই এ দেশের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার গোড়াপত্তন। আর এখন তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই চর্চা ছড়িয়ে পড়েছে। একটা সময় কিন্তু বিভিন্ন স্কুল-কলেজে একজন গানের শিক্ষক, একজন শরীরচর্চার শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু পরে কেন সেই ধারা অব্যাহত থাকল না, আমি জানি না। তবে এখন আমরা সবাই অনুধাবন করছি যে, সমন্বিত শিক্ষা ছাড়া একজন আদর্শ মানুষ তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব। এ কারণেই আবার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীতচর্চা শুরু হয়েছে। কারণ, চারদিকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক নানা শক্তি যেভাবে দানা বেঁধেছে, নানা আগ্রাসন রয়েছে, সেসব প্রতিহত করতেই বর্তমান সরকার সংস্কৃতিচর্চার গুরুত্ব অনুধাবন করেছে। এজন্য একজন শিশু বেড়ে ওঠার দিনগুলোতেই যেন শিল্পচর্চার মধ্যে যাতে থাকতে পারে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। পাঠ্যসূচিতে শিল্পচর্চাকে অন্তর্ভুক্তির এই বিষয়টা অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং ফলপ্রসূ।
আমার খুব ভালো লাগে, দেশের প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা একাডেমি রয়েছে। কিছুদিন আগে খুলনা শিল্পকলা একাডেমিতে গিয়ে মনটা ভরে গেল। কত বাচ্চা গান শিখছে, নাচ শিখছে, আবৃত্তি শিখছে, নাটক করছে। তবে এই চর্চাটা যদি শুধু জেলা পর্যায়ে না রেখে মফস্বল কিংবা গ্রাম-গঞ্জে নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে আমরা আরও দ্রুত সুফল পাব। কারণ শিল্পের প্রতি নানা কারণে যাদের বিরাগ তৈরি হয়েছে তাদের কাছে যেতে হবে। এই যে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে গান, নাচ, আবৃত্তি, শরীরচর্চা যুক্ত করা হচ্ছে, এতে করে তারা এসবের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
আর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও যে গান, নাচ কিংবা নাটক নিয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি হয়েছে, এতে করে তরুণ প্রজন্মের অনেকেই শিল্পচর্চার মধ্যে থেকেই জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পাচ্ছে। রিয়েলিটি শো বা ট্যালেন্ট হান্টকেও আমি মোটাদাগে খারাপ বলছি না। তারাও তো একভাবে শিল্পের সঙ্গেই আছে। অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। তবে শিল্পের উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যদি তারা একটু যত্নবান হন তাহলে খুব ভালো হয়। ফিউশনের নামে ফোক বা রবীন্দ্রসংগীতকে নষ্ট করার তো দরকার নেই। নতুন করে গানের কথা লিখে, সুর করে ফিউশন করুন, কেউ তো আপত্তি করছে না। আরেকটা বিষয় হলো, ট্যালেন্ট হান্ট থেকে যে শিল্পীরা উঠে আসছে তারা কিন্তু টিকে থাকছে না দীর্ঘদিন। এমন ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সেখানেও পরম্পরা তৈরি হয়। নয়তো এসব আয়োজনের সামগ্রিক সার্থকতা থাকবে না।
অনুলিখন : মাসিদ রণ
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৯/০২/২৩
দেশ বিদেশের শিক্ষা, পড়ালেখা সম্পর্কিত সর্বশেষ সংবাদ শিরোনাম, ছবি, ভিডিও প্রতিবেদন সবার আগে দেখতে চোখ রাখুন শিক্ষাবার্তায়