সরকারের সু-মতিতে জনগনের দুর্গতি !
নিউজ ডেস্ক।।
তিন দিন ধরে দেশের পরিবহন খাত অচল। বুধবার ডিজেলের দাম বাড়ার ঘোষণার পরই দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি চলাচল বন্ধ করার পথে হাঁটে পরিবহন নেতারা। ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার আগে শুরু হয় দুর্ভোগে ঠেলে দিয়ে মানুষকে জিম্মি করার প্রক্রিয়া। ডিজেলচালিত বাসের নেতাকর্মীদের সঙ্গে অঘোষিত ধর্মঘটে নামেন সিএনজিচালিত বাসকর্মীরাও। দেখাদেখি নৌপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য একটাই, পরিবহন নেতাদের প্রস্তাবিত ভাড়া নির্ধারণের দাবি যেন মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার।
ধর্মঘট ডাকতে হলে অন্তত ১৫ দিন আগে ঘোষণা দিতে হয়। হঠাৎ করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেশের মানুষকে এভাবে জিম্মি করার সুযোগ নেই প্রচলিত আইনে। তা করলে রুট পারমিট, ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ বা স্থগিত করার সুযোগ আছে। তাই কর্মবিরতির পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। মূলত শক্তি প্রদর্শন করতে জনগণকে এভাবে জিম্মি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সড়ক পরিবহন খাতের এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির বাতাস লেগেছে নৌ খাতে। মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি তারাও। গতকাল শনিবার দুপুর থেকে ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে লঞ্চগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে করে দক্ষিণাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ সদরঘাটে গিয়ে দেখেন ঘাটে লঞ্চ নেই। পরিবহন খাতের কুশীলবদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে দেশের মানুষকে জিম্মি করলেও কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি এখন পর্যন্ত।
গত দুদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পরিবহন খাতের অঘোষিত ধর্মঘট বন্ধ রেখে যান চালুর আহ্বান জানিয়েছেন। একইভাবে ভাড়া বাড়ানোর ইঙ্গিতও দেন তার বক্তব্যে। কিন্তু তাতেও পরিবহনকর্মীরা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসেননি।
গতকাল ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জনগণের ওপর বাড়তি চাপ যেন সহনীয় পর্যায়ে থাকে, সে ব্যাপারে ইতিবাচক উদ্যোগ ও প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।
গতকাল দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন পণ্য পরিবহন খাতের নেতারা। বৈঠক থেকে বেরিয়ে তারা তাদের অঘোষিত ধর্মঘট চালিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ট্রাক-শ্রমিক ফেডারেশনের এ বৈঠক ছাড়াও গতকাল সন্ধ্যায় পরিবহন নেতাদের সঙ্গে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। অবশ্য বৈঠকের ৪০ মিনিট আগে তা স্থগিতের ঘোষণা আসে।
সূত্রমতে, বাসভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ নিয়ে বৈঠক বসছে আজ রবিবার; ডিজেলের দাম বাড়ানোর তিন দিন পর। পরিবহন খাত সূত্রের দাবি, সরকার ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করবে, এটা সবাই জানেন। দুর্ভোগ লাঘবে রবিবারের বৈঠক আরও এগিয়ে শুক্র বা শনিবারে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তাতেও রাজি হননি পরিবহন নেতারা। মূলত ধর্মঘট অব্যাহত রাখা হয়েছে ভাড়া বাড়ানোর বৈঠকে দর কষাকষিতে এগিয়ে থাকার জন্য। যাতে বাড়ানোর হার মালিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী হয়। একই অবস্থা নৌ খাতেও। সড়ক ও নৌ খাত নিয়ন্ত্রণ করেন সরকারপন্থি হিসেবে পরিচিতরাই। ফলে তারা সরকারি বৈঠকে বসলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা থাকেন কোণঠাসা। নেতাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে সচরাচর।
সড়ক খাতে ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটিতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি থাকলেও পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের প্রভাব থাকে বেশি। গত তিন দিন ধরে দেশব্যাপী যে মানুষের জিম্মিদশা, তারও বড় কারণ এসব নেতাদের অনৈতিক ইচ্ছার প্রতিফলন। ভাড়া নির্ধারণে তাদের প্রস্তাব মানার পরই সড়ক পরিবহন আইন তাদের মর্জিমতো শিথিলের সুযোগটা বাড়বে। ইতোমধ্যে আইনের ৯টি ধারার কার্যকারিতা স্থগিত আছে পরিবহন নেতাদের চাপেই। এবার ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটলে সড়ক পরিবহন আইনকে কাগুজে পরিণত করতে চাওয়া হবে পরবর্তী লক্ষ্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভর দেশের সড়ক ও নৌপরিবহন। এ কারণেই প্রতিবার পরিবহন খাতের নেতারা মানুষকে জিম্মি করে তাদের দাবি মানতে বাধ্য করেন। ডিজেলচালিত ট্রেন সেবা অব্যাহত আছে। কারণ এটি সরকারি পরিবহন। এ রকম বিআরটিসি, বিআইডব্লিউটিসিসহ সরকারি
প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়লে মানুষকে এভাবে জিম্মি করার সুযোগ কম পেতেন পরিবহন নেতারা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে উদ্যোগ কম। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ‘বহু বাস মালিকের প্রথা’ থেকে বের হচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, এ খাতের জিম্মি দশা কাটাতে ‘বহু মালিকপ্রথা’ থেকে বেরিয়ে বড় বাস কোম্পানিতে জোর দিতে হবে।
পরিবহন নেতারা বলছেন, করোনায় অন্যান্য খাতে সরকারের ঋণ ও সাহায্য সহযোগিতা পেলেও পরিবহন খাত ছিল উপেক্ষিত। ব্যাংক সুদ মওকুফ এবং ঋণের টাকা করোনার মহামারীতে স্থগিত রাখার দাবি ছিল পরিবহন নেতাদের। কিন্তু তারা সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এরই মধ্যে বেড়ে গেছে বঙ্গবন্ধু সেতু ও মুক্তারপুর সেতুর টোল। কদিন পর আবারও জ্বালানির দাম বৃদ্ধির ঘোষণা পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের দ্রুত একজোট হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে সড়ক খাতের পর গতকাল নৌ খাতের কর্মীরাও মানুষ জিম্মি করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়া বৃদ্ধির দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ নৌপথে লঞ্চ চালাবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন সাধারণ লঞ্চ মালিকরা।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর সদরঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল সংস্থার কার্যালয়ে সাধারণ লঞ্চ মালিকদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে মালিকরা লঞ্চ না চালানোর অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তবে সংগঠনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
সাধারণ লঞ্চ মালিকদের সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের প্রেসিডেন্ট মাহাবুব উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘লঞ্চ চলাচলের বিষয়ে কারও ঘোষণা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা আমাদের দাবি চেয়ারম্যানকে জানিয়েছি। ভাড়া বৃদ্ধিসহ এগুলো পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মালিকরা লঞ্চ চালাবেন না।’
শুক্রবার রাতে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানের কাছে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবের চিঠি পাঠানো হয়। মাহবুব উদ্দিন আহমদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ৩ নভেম্বর সরকার হঠাৎ করে জ্বালানি তেল তথা ডিজেলের মূল্য লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় এবং ওই দিন রাত ১২টা থেকে কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে নৌযান পরিচালনা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যায়। সঙ্গত কারণে সারা দেশে লঞ্চ মালিকরা যাত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করার জন্য সংস্থাকে অনুরোধ করেন। অন্যথায় জাহাজ পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশ করেন।
এতে আরও বলা হয়েছে, জ্বালানি তেলের মূল্য লিটারপ্রতি ১৫ টাকা এবং এরই মধ্যে স্টিল ও অন্যান্য পণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে, তাই ব্যবসায় টিকে থাকার লক্ষ্যে লঞ্চ ভাড়া ১০০ কিমি পর্যন্ত ১ টাকা ৭০ পয়সার পরিবর্তে ৩ টাকা ৪০ পয়সা এবং ১০০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে ১ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণের জন্য অনুরোধ করা হলো। মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ। স্টিলের দাম বেড়েছে ২০-২৫ শতাংশ। এসব কিছু মিলিয়ে আমরা শতভাগ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছি।’
এদিকে সড়ক পরিবহন খাতের অবস্থায় সাধারণ মানুষ নাজুক দিনাতিপাত করছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকৃত বাসের বর্তমান ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা। দূরপাল্লার রুটে ডিজেলচালিত বাসের ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সা। বর্তমানে বেড়েছে ডিজেলের দাম। সেই হিসাবে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব আসতে পারে ডিজেলচালিত বাহনে। কিন্তু সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বৃদ্ধির চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এর যুক্তি হিসেবে বাস মালিকরা বলছেন, ২০১৫ সালে সর্বশেষ সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়ানো হয। এ সময়ে টায়ার টিউব, যন্ত্রাংশসহ নানা উপকরণের খরচ বেড়েছে। তাই সিএনজিচালিত বাস মালিকরাও এখন গাড়ি বন্ধ রেখেছেন। পরিবহন নেতারা আরও বলছেন, ডিজেলচালিত বাহনের ভাড়া বৃদ্ধির জন্য ২০১৯ সালে করা প্রস্তাব বাস্তবে রূপ পায়নি। এর পর করোনাসহ নানা কারণে যানবাহন পরিচালন ব্যয় বেড়ে গেছে। আর প্রতিটি উপখাতেই খরচের পরিমাণ অস্বাভাবিক দেখাতে পটু পরিবহন নেতারা।
বাস মালিকরা বলছেন, সর্বশেষ ২০১৩ সালে দূরপাল্লার বাসের ভাড়া বেড়েছিল। ডিজেলের দাম কমায় ২০১৬ সালে বাসের ভাড়া কিলোমিটারে তিন পয়সা কমিয়ে এক টাকা ৪২ পয়সা করেছিল সরকার। গত আট বছরে যন্ত্রাংশ, বেতন ভাতা, সরকারি ভ্যাট ট্যাক্সসহ সব কিছুর দাম বেড়েছে। ২০১৯ সালে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি, দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারে দুই টাকা ৭ পয়সা এবং ঢাকা চট্টগ্রামের অভ্যন্তরীণ রুটের বাস ভাড়া এক টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে কিলোমিটারে দুই টাকা ২১ পয়সা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছিল।
সরকার সেই ভাড়া কার্যকর করেনি। এখন এর চেয়ে আরও বেশি ভাড়া নির্ধারণের দাবি করছেন পরিবহন নেতারা। এখন দূরপাল্লায় প্রতি কিলোমিটারে ন্যূনতম আড়াই টাকার দাবি তুলতে চান পরিবহন নেতারা। আর মহানগরীতে তিন টাকার বেশি প্রতি কিলোমিটারে দাবি করতে চান বাস মালিকরা। তারা এ ভাড়া বৃদ্ধির পরিমাণ সরাসরি বলছেন না, মূলত মনগড়া ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখ করেছেন। সেখানে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানো হয় প্রতিবার।
সাধারণত ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রায় ১৯টি উপাদান বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে নতুন বাস কেনা, বডি তৈরি ও ভ্যাটসহ বিনিয়োগ, ব্যাংক সুদ, রেজিস্ট্রেশন ও নাম্বারপ্লেট বাবদ খরচ, মাসিক গড় কার্যদিবস, বছরে মোট কার্যদিবস, দৈনিক গড় কিলোমিটার, বার্ষিক গড় কিলোমিটার, স্যালভেজ ভ্যালু, ইকোনমিক লাইফ, যাত্রী আসন ও গড় বোঝাই হার রয়েছে।
এ ছাড়া গাড়ি পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে ক্রয়, ব্যাংকসুদ, রেজিস্ট্রেশন ফি, জ্বালানি খরচ, মবিল, যন্ত্রাংশ, রুটিন মেনটেইনেন্স, সিডিউল মেনটেইনেন্স, ইঞ্জিন ওভারহলিং, গ্যারেজ, টার্মিনাল খরচ, ইন্স্যুরেন্স, অনুমিত আয়কর, শ্রমিক মজুরি, টোলসহ বিভিন্ন উপখাত রয়েছে। ২০১৯ সালে দূরপাল্লার বাসের ২ টাকা ৭ পয়সা ধরা হয়েছিল। সে সময় যেসব খরচ ধরা হয়েছিল, সেগুলোর অধিকাংশ উপখাতে ১০ শতাংশ হারে ব্যয় বেশি দেখানো হচ্ছে এবার। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও আগের চেয়ে ১০-২০ ভাগ বাড়িয়ে উপখাতে ব্যয় দেখানোর চেষ্টা করছেন পরিবহন নেতারা।