শাখা ক্যাম্পাসের অনুমোদন ছাড়াই চলছে স্কুল কলেজ
নিউজ ডেস্ক।।
রাজধানীতে মালিবাগ, বারিধারা, মিরপুর ও উত্তরায় সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের চারটি ক্যাম্পাস আছে। প্রতিষ্ঠাকালে প্রথমটির জন্য শিক্ষা বোর্ড থেকে পরিচালনার অনুমতি ও পরে স্বীকৃতি নেয়া হয়। প্রায় আড়াই বছর আগে সেই মেয়াদও পার হয়ে গেছে। পরিচালনা কমিটি নেই প্রায় সাড়ে ৪ বছর।
তবু চলছে প্রতিষ্ঠানটি।অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সাউথ পয়েন্টই নয় রাজধানীতে নামকরা প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই চালাচ্ছে অনুমতিবিহীন ক্যাম্পাস এবং শাখা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভিকারুননিসা নূন, মতিঝিলের আইডিয়াল, খিলগাঁওয়ের ন্যাশনাল আইডিয়াল, মিরপুরের মনিপুর, উত্তরার মাইলস্টোন, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার, টাঙ্গাইল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এভাবে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান অননুমোদিত শাখা-ক্যাম্পাস খুলে ভর্তি করছে শত শত শিক্ষার্থী।
সরকারি এমপিও নিতে হয় না বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে নিয়োগ করা হয় শিক্ষক ও কর্মচারী। পরে তাদেও বেতন-ভাতা দেয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হয় গলাকাটা ফি। ওইসব ফি কোন খাতে ব্যয় হয় আর কোথায় যায় তা নিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরীক্ষা হয় না। ভর্তি, প্রশাসনিক ও আর্থিক খাত নিয়ে আছে স্বচ্ছতার ঘাটতি।ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, বোর্ডের আইন অনুযায়ী ক্যাম্পাস বা শাখা খোলার কোনো বিধান নেই।
সেই হিসেবে যারাই ক্যাম্পাস খুলেছেন তারা অবৈধ কাজ করেছে। শিক্ষার্থী বেশি হলে শ্রেণি (একই ভবনে) খোলা যাবে। তবে সেটার অনুমোদন নিতে হবে।সাউথ পয়েন্ট স্কুলের মালিবাগ ও বারিধারা ক্যাম্পাস নিজস্ব ভবনে পরিচালিত হচ্ছে। মিরপুরের ক্যাম্পাস ভাড়াবাড়িতে আর উত্তরায় নিজস্ব জমিতে টিনশেড ভবনে ক্যাম্পাস পরিচালনার কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হামিদা আলী।তিনি শুক্রবার বলেন, এসব শাখায় সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে।
কর্মরত আছেন ১ হাজার ৩শ’ শিক্ষক। অভিভাবকদের চাহিদা আছে এবং উপকার হয় বলেই এসব ক্যাম্পাস চলছে। তবে এরপর আর কোনো ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠা করা হবে না। মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকৃতি আর কমিটি ঠিকঠাক করার কাজ চলছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।সাউথ পয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শাখা আছে। বনানীতে ক্যাম্পাস আছে বলে জানা যায়। তবে বিষয়টি নিশ্চিত করেননি হামিদা আলী। জুলাইয়ে করোনার মধ্যে শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে সমালোচনায় পড়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। এরপর শোকজও দেয়া হয়
।ঢাকা শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী ক্যাম্পাসের অনুমোদন নেই। প্রতিষ্ঠানটির মুগদাপাড়ায়ও একটি ক্যাম্পাস আছে। মতিঝিলের প্রধান ক্যাম্পাস এবং মুগদাপাড়ায় বেশকিছু অতিরিক্ত শ্রেণি-শাখার অনুমোদন নেই। ২০১৮ সালে ভর্তি পরীক্ষায় খাতা জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত হয়।
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মাত্র ২০টি শাখার অনুমোদন আছে। এছাড়া অন্তত ৩০টির মতো বাংলা-ইংরেজি ভার্সনের শাখা-শ্রেণির অনুমোদন নেই। বসুন্ধরা, ধানমণ্ডি এবং আজিমপুরে প্রতিষ্ঠানটির শাখা আছে। গোটা উত্তরাজুড়ে ক্যাম্পাস খুলে বসেছে মাইলস্টোন স্কুল ও কলেজ। এসংখ্যা ৩২টির কম হবে না বলে ঢাকা বোর্ডের কলেজ শাখা থেকে জানা গেছে।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল ও কলেজের নিম্ন মাধ্যমিকের অনুমোদন না থাকায় ফেব্রুয়ারিতে জেএসসি পরীক্ষার অনলাইন নিবন্ধন আটকে দেয়া হয়েছিল। এটির সঙ্গে তখন ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একই ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিরপুরের মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের মূল ক্যাম্পাসের বাইরে চারটি ব্রাঞ্চ বা ক্যাম্পাস আছে। এর মধ্যে মূলটির অনুমোদন আছে। এছাড়া কোনো ক্যাম্পাসেরই অনুমোদন নেই। পুরনো স্কুলটি চলছিল শুধু পাঠদানের অনুমতি দিয়ে। বোর্ডের কোনো স্বীকৃতি নেয়া হয়নি। ৯ বছর চলেছে অনুমোদন-নবায়ন ছাড়াই। অথচ ৩ বছর পরপর তা নবায়নের বিধান আছে।
এ বিধান লঙ্ঘন করায় সর্বশেষ বিগত এইচএসসি পরীক্ষায় প্রবেশপত্র আটকে দেয় বোর্ড। তখন বাধ্য হয়ে একবারে অনুমোদন নবায়ন করে নেয় তারা। এছাড়া অনুমোদন পাওয়া ক্যাম্পাসেও অনুমোদনবিহীন বেশ কয়েকটি শ্রেণি-শাখা খোলার অভিযোগও আছে এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ আছে, অবৈধ শাখা-ক্যাম্পাস খোলা ও পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির অসৎ সভাপতি ও সদস্যরা সহযোগীর ভূমিকায় থাকেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও যুক্ত থাকেন। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত শাখা ধরে ফরম পূরণ ও রেজিস্ট্রেশন আটকে দিলে এভাবে বছরের পর বছর অবৈধ কার্যক্রম চলত না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ নিয়ে করা সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, সরকারের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ইচ্ছামাফিক শত শত শ্রেণি ও শাখা খুলে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করে কোটি কোটি টাকা আদায় করা হচ্ছে। অনুমোদনহীন এসব শাখা-ক্যাম্পাস খোলার মূল উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এবং শিক্ষার্থী ভর্তি বাণিজ্য। এতে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকরা উপকৃত হচ্ছেন না। বরং এসব অবৈধ শাখায় শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতার জন্য মাসে মাসে অতিরিক্ত টিউশন ফি গুনতে হচ্ছে। করোনাকালে অভিভাবকের ওপর ফির খড়গ নেমে আসার অন্যতম কারণ এ অবৈধ শাখা-ক্যাম্পাস। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সন্নিকটেই নামকরা প্রতিষ্ঠানের এ ধরনের কার্যকলাপ বছরের পর বছর কিভাবে চলছে তা রহস্যজনক।
অবশ্য ঢাকা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, অবৈধ শাখা-ক্যাম্পাস সরকারের নজরে আছে। ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শোকজ পাঠিয়েছি। এছাড়া সরেজমিন তদন্ত ও পরিদর্শন চলছে।
আরও বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চেইনশপের মতো একই নামে স্কুল-কলেজের শাখা খুলে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের শাহিন স্কুল ও কলেজ এবং ঢাকার ক্যামব্রিয়ান অন্যতম। টাঙ্গাইল স্কুল ও কলেজ একটির অনুমতি নিয়ে ৫টি স্কুল শাখা খুলে বসেছে। বিভিন্ন অভিযোগে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে তদন্ত চালায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। এর ভিত্তিতে পরে শোকজ করা হয়।
ক্যামব্রিয়ান স্কুল ও কলেজের উদ্যোক্তা লায়ন এমকে বাশার বলেন, ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নারায়ণগঞ্জে তার যে ক্যাম্পাস আছে সেগুলো সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে চালানো হচ্ছে। এগুলোর আলাদা পরিচিতি নম্বর (ইআইআইএন) আছে। ঢাকায় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের কাজ চলছে। সেটি হয়ে গেলে গুলশান-বারিধারা এলাকার সব ক্যাম্পাস গুটিয়ে ফেলা হবে।সুত্র যুগান্তর