পতিত সরকারের আমলে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন বলরামপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাঃ নিয়োগ বাণিজ্য, মাদ্রাসার সম্পদ তছরুপ, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর অর্থ আত্মসাৎ, এনটিআরসিএ'র মাধ্যমে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের কাছে বিভিন্ন বাহানায় অর্থ আদায়, সরকারি প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, ছাত্রীদের সাথে অসৎ আচরণ, মাদ্রাসায় না আসা শিক্ষকের বেতন ভাগাভাগি করে নেওয়া সহ একাধিক অভিযোগ উঠেছে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার বলরামপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মোঃ মমতাজুল ইসলামের (ইনডেক্স নং- 099535) বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০২ সাল থেকে সুপার পদে দায়িত্বে থাকা মো: মমতাজুল ইসলাম নিয়োগ বাণিজ্য, মাদ্রাসার অর্থ আত্মসাৎ, মাদ্রাসার নিজস্ব সম্পদ ও মার্কেট থেকে প্রাপ্ত আয় আত্মসাৎ, রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সভাপতি এবং নিজস্ব বলয়ের ব্যক্তিদের কমিটির সদস্য বানিয়ে গত দুই যুগে অন্তত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
জানা গেছে, নিজস্ব ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোঃ জিয়াউর রহমানকে সভাপতি বানিয়ে ২০১৫ সালে নিজের ছেলের বউ জাকিয়াকে সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) পদে নিয়োগ বাগিয়ে নেন। এরপর ২০২০ সালে আয়া পদে ১০ লাখ টাকা ঘুসের বিনিময়ে রুখসানা পারভীন নামের এক নারীকে নিয়োগ প্রদান করেন। একই সময়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে মোস্তাকিম নামের ব্যক্তির থেকেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা নিয়ে নিয়োগ প্রদান করেন। এরপর সর্বশেষ সেই একই সভাপতি মোঃ জিয়াউর রহমানকে ২০২৪ সালের জুন মাসে তার (সভাপতি) ভাইয়ের বউ ফেরদৌসী আরাকে ল্যাব সহকারী পদে নিয়োগ প্রদান করেন। একই নিয়োগে সহকারী সুপার পদের জন্য দশ লক্ষ টাকার চুক্তি করা হয় সেখান থেকে সভাপতি কোন টাকার ভাগ পাবেন না বলে অলিখিত চুক্তি করে সহকারী সুপার পদে মাহফুজা খাতুনকে নিয়োগ প্রদান করেন এবং এমপিওভুক্ত করান। সভাপতির ভাগের টাকায় সভাপতি তার ভাইয়ের বউকে নিয়োগ দেন এবং সুপারের ভাগের অংশ পান সহকারী সুপার পদে নিয়োগ দিয়ে।
প্রতিষ্ঠানটির বেশ কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনটিআরসিএ'র মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া যেসব শিক্ষক এখানে যোগদান করেছেন তাদের যোগদান থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন কাজে টাকা দিতে বাধ্য করেছেন। এমনকি এনটিআরসিএ'র নিয়োগ সুপারিশের আলোকে কোন প্রতিষ্ঠান প্রধানের অর্থ নেওয়ার কোন সুযোগ না থাকলেও সুপারকে অর্থ দিয়েই যোগদান করতে হয়েছে। এছাড়া শিক্ষকদের এমপিও, উচ্চতর স্কেল, বিএড স্কেল ইত্যাদি ফাইল প্রেরণের ক্ষেত্রে সুপারকে টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। টাকা না দিলে এমপিও ফাইল পাঠাবেন না বলে জানান তিনি। কারণে অকারণে শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির হুমকি প্রদান করার অভিযোগও উঠে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসন আমলের এই ১৬ বছরে প্রভাবশালী সুপার পদে অধিষ্ঠিত হওয়া সুপার মোঃ মমতাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদ্রাসার নামে 'ফিক্সড ডিপোজিট' করে রাখা 'এফডিআর' এর অর্থ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে তিনি উত্তোলন করেন। ২০২৩ সালে 'পারফরমেন্স বেজড গ্রান্টস ফর সেকেন্ডারি ইন্সটিটিউশনস' (pbgsi) প্রকল্পের আওতায় ৫ লক্ষ টাকা করে প্রদান করা অর্থ পায় বলরামপুর দাখিল মাদ্রাসা। এই পাঁচ লক্ষ টাকার মধ্যে ১ লাখ টাকা শিক্ষকদের মাঝে বন্টন, বইপত্র- লাইব্রেরি, শিক্ষা উপকরণ এবং গবেষণাগার সরঞ্জাম ইত্যাদিতে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়, ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য ফ্যাসিলিটির (অবকাঠামো, বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার, কমনরুম ইত্যাদি) উন্নয়নে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়, সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তা ব্যয় ৭৫ হাজার টাকা এবং প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের জন্য বলা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটির সুপার মোঃ মমতাজুল ইসলাম এই পাঁচ লক্ষ টাকার একটাকাও ব্যয় না করে ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে পুরো টাকাটাই আত্মসাৎ করেন। প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের কথা বলা হলেও মাদ্রাসাটির একমাত্র বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থী (প্রকল্প চলাকালীন সপ্তম শ্রেণি ছাত্র) মারুফ হোসেনকে একটাকাও দেওয়া হয়নি। প্রকল্পে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য টাকা আসছে যেনে শিক্ষার্থী মারুফ হোসেনের পিতা হতদরিদ্র পেশায় ভ্যান চালক মোঃ মতিউর রহমান বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর ২০২৩ সালের ২৮ নভেম্বর লিখিত অভিযোগ করেন। এরপর তাকে ডেকে নিয়ে সুপার এবং সভাপতি তাকে কিছু টাকা দিয়ে বিষয়টি সমাধান করেন। অভিযোগের কপি শিক্ষাবার্তা'র হাতে রয়েছে।
শুধু এই প্রকল্পের অর্থই আত্মসাৎ করে ক্ষ্যান্ত থাকেননি সুপার মমতাজুল। তিনি মাদ্রাসার পুকুর আবাদি জমি ও ভাড়া দেওয়া মার্কেট থেকে প্রাপ্ত আয় সুপারের দুই যুগের শাসন আমলে একটাকাও মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যয় করেননি এমনকি মাদ্রাসার নামের ব্যাংক একাউন্টে জমা দেননি। মাদ্রাসার গাছ বিক্রির টাকা আত্নসাৎ, শিক্ষার্থী থেকে প্রাপ্ত টিউশন ফি'র টাকা আত্নসাৎ সহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত তিনি। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বসার আসনের অভাবে মেঝেতে বসে পরীক্ষা দিতে হয়।
মাদ্রাসার আরেক শিক্ষক (সহকারী শিক্ষক কৃষি) মোঃ হাফিজুর রহমান (ইনডেক্স নম্বর 692745) যিনি সুপারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। মাদ্রাসায় তার উপস্থিতি থাকার প্রয়োজন নেই তিনি একটি ক্লাসও নেননা। উপস্থিতি না থাকলে কিংবা ক্লাস না নিলেও তার বিরুদ্ধে কখনও একটি কারণ দর্শানোর নোটিশ পর্যন্ত প্রদান করা হয়নি। এর কারণ তিনি মান্থলি পেমেন্ট অর্ডারের (এমপিও) যে অর্থ পান তার অর্ধেক নেন তিনি বাকি অর্ধেক পান সুপার মোঃ মমতাজুল। গত ৮ বছরে মাঝে মাঝে তিনি নামে মাত্র মাদ্রাসায় উপস্থিত থেকেছেন। মাদ্রাসার হাজিরা খাতার কপি শিক্ষাবার্তা'র হাতে রয়েছে। ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত শিক্ষক হাফিজুর রহমান কোথায় ছিলেন তা কেউই জানতেন না। অথচ এই সময়ের পুরো এমপিওর অর্থ এক সাথে বিল করে সর্বমোট ২ লাখ ৮৬ হাজার টাকা উত্তোলন করেন। যার প্রমাণ শিক্ষাবার্তা'র হাতে রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন হাজার টাকা বেতনে প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস করিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় মাদ্রাসা না আসলেও সর্বশেষ ২০২৩ সালে টাইমস্কেল বাগিয়ে নেন এই শিক্ষক। বর্তমানে তিনি ৮ম স্কেলে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। আর এসবের পেছনে মূল নায়কের চরিত্রে সুপার মমতাজুল ইসলাম।
শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারিই নয় সুপার মাদ্রাসার ছাত্রীদের হিজাব খুলতে বাধ্য করা ও বাজে ব্যবহার এবং কোন ধরণের শিক্ষক সুলভ আচরণ করেন না বলে শিক্ষাবার্তার'র কাছে অভিযোগ করেন একাধিক ছাত্রী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী ক্ষমতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত সুপার মমতাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেঁসে উঠেছেন এলাকাবাসী। তারা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। বর্তমানে তারা গণস্বাক্ষর শুরু করেছেন সুপার মমতাজুল ইসলামের পদত্যাগ এবং বিচারের দাবিতে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সুপার মোঃ মমতাজুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাঃ জুলফিকার আলী শাহ শিক্ষাবার্তা'কে বলেন, আমার কাছে এ বিষয়ে কোন অভিযোগ আসেনি এমনকি কেউ জানায়নি। আপনি মাদ্রাসাটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন জানতে পারবেন।
মাদ্রাসাটির গভর্নিং বডির সভাপতি ও বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ফজলে এলাহীর মুঠোফোনেও বেশ কয়েকবার কল করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০৭/০৯/২০২৪