শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের অপমান এক লজ্জাজনক বাস্তবতা
মো. কামাল উদ্দিনঃ এই লেখাটি লিখতে বসে আমার ফেলে আসা শিক্ষা জীবনের স্মৃতিগুলো ঝাপসা হয়ে উঠল। একেবারে শিশুকালে, যখন প্রথম স্কুলে গিয়েছিলাম, তখনকার কথা মনে পড়ে। আমার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল চরণদ্বীপ আব্বাসিয়া প্রাইমারি স্কুলে। এই স্কুলটি আমাদের চরণদ্বীপের দেলোয়ার হোসেন চৌধুরীর পূর্বপুরুষরা ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমি সেই গৌরবময় ইতিহাসের প্রাচীন বিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে প্রথম পাঠ গ্রহণের স্মৃতিতে এখনও আবদ্ধ।
যেসব শিক্ষকের কাছ থেকে আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম পাঠ গ্রহণ করেছিলাম, আজ তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। সেই শিক্ষকদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা চিরস্থায়ী। আমার শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেসব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কাছ থেকে আমি শিক্ষার আলো পেয়েছি, তাদের প্রতি আমি মনেপ্রাণে কৃতজ্ঞ। তাদের শিক্ষাকে বুকে ধারণ করেই আজকের শিক্ষকদের প্রতি অপমানজনক আচরণ নিয়ে কিছু কথা লিখতে বসেছি। শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব, কারণ তারা আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক।
এই লেখাটি তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য এবং শিক্ষার পবিত্রতাকে রক্ষা করার প্রয়াস।বর্তমান সময়ে আমরা যে এক মারাত্মক সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তা হলো স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট ছাত্ররা নিজেদের কান্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলছে এবং জোরপূর্বক শিক্ষকদের অপমানিত করে পদত্যাগে বাধ্য করছে। এ ধরনের ঘটনা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকগণ, যারা আমাদের সমাজের স্থপতি, আজ তাঁদেরই অপমান করা হচ্ছে, যা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সমগ্র জাতির জন্য এক গুরুতর সংকেত।
এই প্রবণতা যদি দ্রুত বন্ধ করা না হয়, তাহলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ একসময় শিক্ষক শূন্য হয়ে পড়বে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এমন পরিবেশে টিকে থাকতে পারবে না, যেখানে শিক্ষকদের সম্মান নেই। শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা ও নিরাপত্তা হীনতা তৈরি হলে তারা স্বাভাবিকভাবেই পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। ফলস্বরূপ, শিক্ষার মান ও জাতির ভবিষ্যৎ দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু পাঠদান নয়, এটি একটি সামগ্রিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেয়। কিন্তু যখন ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতি এভাবে অপমানজনক আচরণ করে, তখন তা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকেই ভূলুণ্ঠিত করে। ছাত্রদের বুঝতে হবে যে, শিক্ষকদের প্রতি এমন আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শিক্ষার পরিবেশে শৃঙ্খলা ও সম্মান রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অভিভাবকদের, শিক্ষকদের এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে এ ধরনের আচরণ বন্ধ করা যায়। ছাত্রদের মধ্যে নৈতিকতা, শৃঙ্খলা এবং শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের শিক্ষা দিতে হবে। কারণ, শিক্ষকেরা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন, আর তাদের প্রতি অসম্মান জানিয়ে আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎই বিপন্ন করছি।
অতএব, আজই সময়, শিক্ষকদের প্রতি অপমান জনক আচরণ বন্ধ করে শিক্ষার প্রকৃত মর্যাদা ফিরিয়ে আনা। জাতির জন্য এটি এক অশহনি সংকেত, এবং যদি আমরা এখনই সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতে এর ফলাফল আমাদের সকলের জন্যই দুঃখজনক হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহকে শিক্ষক শূন্য হতে দেওয়া যাবে না, কারণ শিক্ষক ছাড়া শিক্ষা অসম্ভব, আর শিক্ষা ছাড়া জাতি মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়বে। শিক্ষক অপমান জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ার শামিল। বর্তমান সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব অসীম। শিক্ষা শুধু জ্ঞানের আলো ছড়ায় না, এটি জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। কিন্তু, সাম্প্রতিক কালে আমরা একটি ভয়াবহ প্রবণতা লক্ষ্য করছি—শিক্ষার্থীদের কতৃক শিক্ষকদের প্রতি অপমান মূলক আচরণ। এ ধরনের ঘটনা শুধু শিক্ষকদের অপমান নয়, এটি পুরো জাতির জন্য এক অশহনি সংকেত। শিক্ষকগণ আমাদের জীবনের এক অনন্য দিকনির্দেশক। তাঁরা আমাদেরকে জ্ঞানের দিশা দেখান, জীবনের মূল্যবোধ শেখান, এবং নৈতিকতার মশাল হাতে ধরে আমাদের সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু যখন সেই শিক্ষকদেরই অপমান করা হয়, তখন তা জাতির ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে গেলে জাতির মেরুদণ্ডও ভেঙে পড়বে, এবং একটি মেরুদণ্ডহীন জাতি কখনও স্থিতিশীল বা উন্নত হতে পারে না।এই প্রবণতা বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষার্থীদের বুঝতে হবে যে, শিক্ষকের সম্মান রক্ষা করা শুধু একটি নৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের মানসিকতা বদলাতে হবে, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও সম্মানের বীজ বপন করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কটি শুধুমাত্র শিক্ষাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। সমাজের সকল স্তরের মানুষকে একযোগে কাজ করতে হবে। অভিভাবকদের, শিক্ষকদের, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। ছাত্রদের বোঝাতে হবে, শিক্ষকদের প্রতি অপমান করে তারা নিজেদেরই ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করছে। এমন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিক্ষকের মর্যাদা প্রশ্নাতীত থাকবে, এবং শিক্ষার্থীদের মনে সেই শিক্ষা গভীরভাবে প্রবিষ্ট হবে।
সর্বোপরি, শিক্ষকদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান ফিরিয়ে আনতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের সকলের উচিত শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা করা, কারণ তাঁদের হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ। আজই সময়, এই জাতীয় অপমানজনক আচরণ বন্ধ করে শিক্ষার আসল গুরুত্ব বুঝে তা অনুধাবন করা। মেরুদণ্ডহীন জাতি হয়ে পড়ার আগে আমাদের সচেতন হতে হবে, কারণ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, এবং মেরুদণ্ডহীন জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন।আমরা এমন পরিবর্তন মোটেই আশা করি না। আমরা একটি সভ্য সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক সম্মান ও শৃঙ্খলার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। কিন্তু সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটছে, তা আমাদের দেশকে অসভ্যতার দিকে ধাবিত করছে। শিক্ষকদের প্রতি অপমানিত আচরণ এবং তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা কোনো সমাধান নয়, বরং এটি আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়কে প্রকাশ করছে। শিক্ষার পরিবেশ রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব, এবং এই ধরনের অপমানজনক আচরণ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক গবেষক টেলিভিশন উপস্থাপক।
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডটকম/এএইচএম/০২/০৯/২০২৪