শিক্ষক শিক্ষার মান আয়নাবাজি ও অবন্তিকার মৃ-ত্যু
কাকন রেজাঃ একজন মেয়ে শিক্ষার্থী একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন, কু প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে অনার্সে ফেল করানো হয়েছে। তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে শিক্ষকদের অত্যাচারে। অবন্তিকার আত্মহত্যার কথা বিষয়ে বলতে গিয়ে সে বলেছে, অবন্তিকা সাহসী বলেই পেরেছে, সে সাহসী নয় বলেই আত্মহত্যা করতে পারছে না। কী ভয়াবহ কথা। শিক্ষকের নামে এরা কারা। এদের পরিচয় কী, এরা কোথা থেকে এসেছে। এদের সাহসের উৎসটা কোথায়। না, এসব বিস্ময়কর কোনো প্রশ্ন নয়। এসব সবই আমরা জানি, আমাদের জানা।
অবন্তিকার হত্যা, হ্যাঁ হত্যাই, তাকে বাধ্য করা হয়েছে আত্মহননের জন্য। সেই হত্যাকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর এবং একজন শিক্ষার্থী। তাদের শক্তির উৎস একই। গণমাধ্যমে একজন লিখেছেনে সেই প্রক্টরের যে যোগ্যতা, তাতে সে একজন পিয়নের চাকরি জোটাতে সক্ষম নন, কিন্তু শুধুমাত্র ক্ষমতার আয়নাবাজিতে তিনি একজন সহকারী প্রক্টর। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রক্টরবাজির কাহিনী আমাদের জানা। অনেক সুবেশী শিক্ষকদের কাহিনীও অজানা নয়। এদের ক্ষমতার উৎসও বলেছি জানা। কিন্তু করার কিছু নেই।
অধ্যাপক ফাহমিদুল হক সামাজিকমাধ্যমে লিখেছেন, এদের রুখে দেয়ার কথা। তিনি অবন্তিকার আত্মহত্যাকে, হত্যা বলেছেন এবং সত্যিকার অর্থেই এটা হত্যা। বিচার চেয়ে, প্রতিকার না পেয়ে নিজেকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছে অবন্তিকা। এই হত্যার প্রকৃতি অন্যান্য হত্যার মতই। সেই শিক্ষক, অবন্তিকার সহপাঠী এরা মূলত হত্যার নির্দেশদাতা। হন্তারক ও হত্যার নির্দেশদাতা সমানদোষী। কিন্তু এক্ষেত্রে হত্যার নির্দেশদাতারা দ্বিগুন দোষী, যারা একজন শিক্ষার্থীকে বাধ্য করেছে নিজেকে হত্যা করতে। এ ঘটনায় হন্তারক ও হত্যার নির্দেশদাতা একই। কিন্তু এদের রুখে দেবে কে, এই প্রশ্নের উত্তর দেননি ফাহমিদুল হক। তিনি শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাহীন বলেছেন কিন্তু শিক্ষক ও সহপাঠীর ক্ষমতার উৎস কোথায় সে কথা বলেননি। সমাধানের আগে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। নাহলে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে, যেখানে বেড়ালরাই ক্ষমতাবান!
অবন্তিকার আত্মহননের পর কথা উঠছে। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে যে মেয়েটি বলেছে তার প্রতি অবিচারের কথা, তাকে অনার্সে ফেল করিয়ে দেবার কথা, এমন অসংখ্য কথা অব্যক্ত রয়ে গেছে। শুধু মেয়েরাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও শিক্ষকদের অবিচারের শিকার হন। যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা- এমন চিন্তার অনেক শিক্ষকই রয়েছেন দেশের বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। গত দেড় দশকে দেশের শিক্ষার পরিবেশ, মান নিচে নামতে নামতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর শিক্ষকদের মান নিয়ে তো কথাই নেই। শিক্ষকদের মান এই জায়গা ঠেকেছে শুধুমাত্র ক্ষমতার আয়নাবাজির জন্য। অ্যাস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষে থাকলেই হলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর সেই পক্ষে থাকা প্রমাণ করেছেন একটি ছবির মাধ্যমে। অবন্তিকার আত্মহননের সাথে সাদি মহম্মদের মৃত্যুর একটা অন্তর্নিহিত মিল রয়েছে। সাদি মহম্মদও অবিচারের শিকার। পুরস্কারের ক্ষেত্রে শুভ্রদেব আর সাদি মহম্মদের তুলনা করলেই সেই মিলটা চোখে পড়ে। চোখে পড়ে আয়নাবাজির লুকায়িত সেই দৃশ্যও।
প্রসঙ্গটা অন্যদিকে নিয়ে যাই। পরে হয়তো বিস্তারিত লিখবো এ বিষয়ে, কিন্তু এ লেখায় একটু সতর্ক করে দিয়ে যাই। দেশে একটা সাম্প্রদায়িক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে এবং তা শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষকদের মাধ্যমেই। ইফতার মাহফিল নিষিদ্ধের আলাপ, কোরআন তেলাওয়াতকারীদের শাস্তির আওতায় আনার কথা, এসব তারই আলামত। এ বিষয়টা মাথায় রাখতে হবে, এটা ইচ্ছাকৃত ফ্যাসাদ বাঁধানোর চেষ্টা এবং সম্ভবত পরিকল্পিতও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাং কিংয়ে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ শিক্ষকদের অনেকেই এখন নিজ ব্যর্থতা ঢাকতে আয়নাবাজির উপর ভর করছেন। এই আয়নাবাজি জাতিকে একটা ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একটু চিন্তা করলেই ভবিষ্যতের সেই ভয়াবহ দৃশ্যটা আপনি দেখতে পাবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৮/০৩/২০২৪