বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাপদ্ধতি, ফি জটিলতা
একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বিভিন্ন মেডিক্যাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার আবেদন করতে গিয়েই অনেকটা ঝরে পড়ে। তার কারণ, সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে হারে ভর্তির আবেদন ফি ধার্য করা হয়, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহু অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করতে পারছে না।
এইচএসসি শেষ করে শিক্ষার্থীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় উচ্চশিক্ষা লাভে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তির। বাংলাদেশে এই ভর্তিযুদ্ধ জটিল প্রকৃতির। তার ওপর আছে আসন-সংকট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে অনেক অভিভাবক অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন আবেদন ফরমের ফি জমা দিতে দিতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো আলাদা আলাদাভাবে বড় অঙ্কের ফি নিয়ে থাকে। পরীক্ষার ফলাফল যাই হোক না কেন, আমি মনে করি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক অধিকার। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে থাকতে হয়। তাই সংগত কারণে ভর্তি পরীক্ষা ফি-মুক্ত করা দরকার। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে গিয়ে আসা-যাওয়া, থাকাতেই যেখানে হাজার হাজার টাকা অপচয় করতে হয়, সেখানে অতিরিক্ত ভর্তি ফি একজন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জন্য একটি বিশাল বোঝা নয় কি? মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং লেভেলে পড়ার ক্ষেত্রে যোগ্যত্য থাকা সত্ত্বেও অসচ্ছল দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত ফি পরিশোধের কারণে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি থেকে ছিটকে পড়ছে।
দেশের সনামধন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনেকের পড়ার ইচ্ছা থাকে কিন্তু অর্থনৈতিক দীনতায় তারা সে আশা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ জাতীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রণ করে, শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি গুচ্ছতে রূপান্তর করে সব শিক্ষার্থীকে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া। সেই সঙ্গে ভর্তির আবেদন ফি তুলে নেওয়া, নয়তো একটি সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণ করা। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃপক্ষ বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশ ক-বছর ধরে একটি গুচ্ছতে একত্রীভূত করে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমি অবস্থার কারণে তা কার্যকর করতে পারেনি। যেখানে ডিজিটাল পদ্ধতির সহায়তায় অনেক কঠিন কাজকে সহজ করে দিচ্ছে, সেখানে এ দুরবস্থা থেকে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উত্তরণ চায়। দেশে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা একসঙ্গে হতে পারলে এই গুটি কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা হতে বাধা কোথায়?
বর্তমানে দেশে মঞ্জুরি কমিশন অনুমোদিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৪টি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত সংখ্যা ১১২টি। এছাড়া তিনটি আছে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে মেডিক্যাল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অভিন্ন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন করার ফলে অল্প খরচে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে যে যেখানে পড়ার সুবিধা পাচ্ছে। এ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একেক ইউনিটে ভর্তি ফরম পূরণ আবেদনে এক থেকে দেড় হাজার টাকা ফি ধার্য করা হয়েছে, এটি শুধু অযৌক্তিক নয়, অনৈতিকও।
শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই অবগত আছেন, শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা যাচাই করে নিতে একজন শিক্ষার্থীকে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করতে হয়। পছন্দের বিষয় ও প্রতিষ্ঠান খুঁজে পেতে একজন শিক্ষার্থীকে কম করে হলেও ৮ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। উদাহরণ-স্বরূপ যদি বলি, কক্সবাজার-টেকনাফ কিংবা পঞ্চগড়-তেতুলিয়া থেকে একজন ছেলে বা মেয়ে শিক্ষার্থী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে কত টাকা রাস্তায় ফেলে দিতে হয়। এই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি এক জন করে অভিভাবক থাকে, তাহলে কী পরিমাণ খরচ পড়ে। যদি একেকটি পরীক্ষায় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়, তাহলে ৮/১০টি ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে খরচ গুনতে হয় ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষা ঘনিয়ে এলে দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী-অভিভাবকমণ্ডলীগণ এক ঘোর অমানিশায় দিন কাটায়। ভর্তি পরীক্ষা সহজীকরণ নিয়ে পত্র-পত্রিকায় শোরগোল পড়ে যায়। কোনোরকমে পরীক্ষাটা নিয়ে ফেলতে পারলে আলোচনাও শেষ, জোর তদবিরও শেষ হয়ে যায়। আলোচনার বিষয় থেকে আবার পুরো একটি বছর নিশ্চুপ হয়ে পড়ে। এভাবে বছরের পর বছর আর কত শিক্ষার্থী তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, কেউ কি বলতে পারেন? বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ও শিক্ষকবৃন্দের উদ্দেশে বলতে চাই, শিক্ষার্থী/অভিভাবকদের এই অভিযোগটি আমলে নেওয়ার কি কোনোরকম সুযোগ নেই? এ বছর আমার সন্তান উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, আগামী বছর আপনার সন্তান কিংবা কাছের দূরের অনেক নিকট আত্মীয়ের সন্তানও অর্থনৈতিক কারণে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া থেকে বঞ্চিত হতে পারে। অতএব শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি কর্তৃপক্ষ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আশু এই বিষয়ে যদি একটি সমাধানে আসে, তাহলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়া থেকে ঘুরে দাঁড়াবে। আর দেরি না করে সরকার, শিক্ষামন্ত্রণালয় ও ইউজিসির উচিত, এই বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণে কঠোর হওয়া। যে কোনো উপায়ে ভর্তি প্রক্রিয়া শিথিল, সেমিস্টার ফি, ভর্তি ফিতে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে অনেকের ধারণা। এর ফলে দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে নতুন গতি ফিরে পাবে বলে দৃঢ় প্রত্যাশা।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/০১/০২/২০২৪