পাঠ্যবই ঘিরে ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতার ঘৃণ্য মিথ্যাচার!
কাজী মাসুদুর রহমানঃ সফল দেশ ও জাতি গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব প্রশ্নাতীত।এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দেশ ও জাতির অগ্রায়নে যুগোপযোগী শিক্ষানীতি একটি অপরিহার্য বিষয়। ইতোপূর্বে সরকার শিক্ষা নীতি -২০২৩ ঘোষণা করেছে।ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ২০২৩ সাল হতে ১ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে পরবর্তন সূচিত হয়েছে।পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বাকি শ্রেণিগুলোতেও এই পরিবর্তন আনা হবে মর্মে পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে। পুঁথিগত মুখস্থ পদ্ধতি ও অভ্যাস এড়িয়ে পরিবর্তিত বৈশ্বিক বাস্তবতার নিরিখে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার লক্ষ্যে ' অভিজ্ঞতা মূলক শিখন পদ্ধতি ' নামে মূলতঃ এই শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছে।শুরুতেই এই পদ্ধতি নিয়ে কিছু অভিভাবক ও মহল বিশেষ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।অর্থাৎ, পাঠ্য বিষয়ের মূল আলোচনা কে বিকৃত করে মনগড়া দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের মাধ্যমে সরকারের গৃহীত এই সময়োপযোগী পদক্ষেপকে বিতর্কিত করার চেষ্টা চালিয়েছে।সেই চেষ্টার নেপথ্যে সরকার বিরোধী শিবিরের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও লক্ষ্য করা গেছে।
আবার কেউ কেউ এর আদ্যোপান্ত না বুঝেই সমালোচনা করেছে এবং করছে।বলা বাহুল্য, দীর্ঘদিন ব্যাপী চর্চিত কোনো নীতিকে যুগ সন্ধিক্ষণের দাবিতে পরিবর্তন,পরিমার্জন করে যখন নতুন চিন্তার আলোকে সৃজন করা হয় তখন তা প্রারম্ভিক পর্যায়ে সাধারণের কাছে শতভাগ গ্রহনীয় নাও হতে পারে।তবে, পরবর্তীতে সঠিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে তার গ্রহনযোগ্যতা ও ফলপ্রসূতা।এ লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে এই নতুন কারিকুলামের বোধগোম্যতা আনায়নের নিমিত্তে শিক্ষকদেরকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।কেননা, সুদক্ষ শিক্ষক ছাড়া শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন অসম্ভব। সুতরাং গৃহীত শিক্ষা পদ্ধতির আল্টিমেট ফলাফল পেতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।তবে এটা অনস্বীকার্য যে, এ পদ্ধতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যুগোপযোগী ও মহৎ।তবে,ঘোষিত নীতি ও প্রণিত পাঠ্যক্রম সুপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে সৃজনশীল তর্ক- বিতর্ক হতে পারে কিন্তু কোনো কুরুচিরকর, অবাস্তব ও অপ্রাসঙ্গিক সমালোচনা গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা।
উল্লেখ্য, গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইন্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে ' জাতীয় শিক্ষক ফোরাম' এর ব্যানারে ' বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তকঃ বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ ' শীর্ষক আলোচনায় ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসিফ মাহতাব নামে এক খন্ডকালীন শিক্ষক অত্যন্ত অশালীন ভাবে অশিক্ষক সুলভ আচরণের মাধ্যমে বর্তমান কারিকুলামের সমালোচনা করেন।সে সময় তিনি ৭ম শ্রেণির ' ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান ' বইয়ের ' মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা ' অধ্যায়ের ' শরীফা' ও ' শরীফার গল্প ' অনুচ্ছেদে ট্রান্সজেন্ডার ও সমকামিতার অভিযোগ তুলে অনুচ্ছেদের দুটি পাতা ছিঁড়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন।ঘটনাটি দ্রুত গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে।
অথচ বইটির ফ্যাক্ট চেকিং এ দেখা যায়, সেখানে সমকামিতা তো দূরের কথা, 'ট্রান্স জেন্ডার' শব্দ চয়ন ঘটিয়ে নুন্যতম কোনো কথাও বলা হয়নি। বরং সেখানে ' থার্ড জেন্ডার ' বা 'হিজড়া' দের নিয়ে কথা হয়েছে। মূলত সেখানে আমাদের সমাজে হিজড়া গোষ্ঠীর মানবিক বিষয়াবলী প্রধান রুপে তুলে ধরা হয়েছে।প্রসঙ্গত: হিজড়া গোষ্ঠীকে থার্ড জেন্ডার হিসাবেও চিহ্নিত করা হয়। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক কারণে ক্রমোজম হরমোনের শরীরবৃত্তীয় পরিবর্তনে কখনো-কখনো নারী ও পুরুষ অনিচ্ছাকৃত ভাবে বিপরীত লিঙ্গে রুপান্তরিত হতে পারে।ইংরেজি পরিভাষায় এদেরকে 'ইন্টার সেক্স' বলা হয়। ন্যাচারাল মেডিকেশন প্রসেসে সংঘটিত এরকম মনো-দৈহিক পরিবর্তিত মানুষদেরকে আমরা 'হিজড়া' বলে থাকি।আবার কোনো-কোনো নারী ও পুরুষ নিজের অস্তিত্বে বিপরীত লৈঙ্গিক রুচি অভিরুচিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে এবং আকৃষ্ট হয়।এটা তাদের একধরনের মানসিক বৈকল্যতা হতে পারে।এরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় বিপরীতধর্মী হরমোন প্রবিষ্টের মাধ্যমে লিঙ্গের পরিবর্তন ঘটায়।এদেরকে 'ট্রান্সজেন্ডার' বা 'রূপান্তরিত লিঙ্গ' বলা হয়। অপরপক্ষে, যারা সমলৈঙ্গিক যৌনাচারে লিপ্ত থাকে তাদেরকে 'সমকামী' বা ' লেসবিয়ান' বলা হয়। উল্লেখিত পাঠ্য গল্পের মূল ভাবে শরীফ নামের একজন পুরুষ শিশুর জীবনের হিজড়া গোষ্ঠীতে অনুপ্রবেশের বেদনাদায়ক গল্প, সামাজিক বৈষম্য, মানবাধিকার ও তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির কথা বলা হয়েছে যা কোমল মতি শিশুদের বিশুদ্ধ মননে অবশ্যই শিক্ষনীয় চেতনার দাবী রাখে।
অর্থাৎ শিশু-কিশোার কাল থেকেই একজন শিক্ষার্থী লিঙ্গ ভিত্তিক সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠে একটি মানবিক ও সাম্যের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ব্রতী হয়ে উঠবে-এটাই এই গল্পের মনস্তত্ত্ব।বলাবাহুল্য,পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই হিজড়াদেরকে রাস্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃত করা হয়েছে এবং দক্ষ মানব সম্পদে পরিণত করা হয়েছে।এরাও রাস্ট্র ও সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশ সরকারও ২০১৩ সালে এদরকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সাফল্যের ভূমিকা রেখে চলেছে।বিস্মিত বিষয় হলো, জাতীয় শিক্ষক ব্যানারে এমনই এক মানবিক বিষয়ে নগ্নতার মিথ্যা ঘৃণ্য প্রলেপ লাগিয়ে প্রকাশ্যে অসামাজিক বক্তৃতা দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর এমন ঔদ্ধত্য তারা কিভাবে পায়?
শিক্ষক ফোরামে প্রকাশ্যে মনগড়া কল্পনাপ্রসূত এমন অপ্রাসঙ্গিক ও অশালীন বক্তব্য কখনোই শিক্ষক সুলভ আচরণ হতে পারেনা। এধরনের অপচর্চা শিক্ষকতার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক বটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর দ্বারা ইস্যুটিকে চরম বিকৃত-নগ্ন ভাবে প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি সচেতন মহলে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।এর পেছেনে সাম্প্রদায়িক কুরাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্য জড়িত থাকার সম্ভাবনা থাকতে পারে বৈকি।কেননা, সাম্প্রদায়িক গোস্ঠী কখনোই এদেশের সার্বজনীন অগ্রসরতাকে মেনে নেয়নি।বিস্ময় ব্যাপার হলো, কিছু মিডিয়াও শরীফার গল্পটিকে ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে আখ্যায়িত করে ষড়যন্ত্রকারীদের আঙ্গিকেই উপস্থাপন করেছে যা অতীব দুঃখ জনক বটে। মানবিকতা ও সামাজিকতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী যে কোনো গোষ্ঠীর এমন অশালীন আস্ফালনকে বাড়তে দেওয়া সমীচীন হবেনা।তা না হলে, এর খারাপ পরিণতি সকলকেই ভোগ করতে হবে।তাই এখনই সময়-এদের বিরুদ্ধে সকল স্তরে সনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং আইনের যথার্থ প্রয়োগ ঘটানো।
লেখকঃ কলামিস্ট
“মতামত ও সাক্ষাৎকার কলামে প্রকাশিত নিবন্ধ লেখকের নিজস্ব। শিক্ষাবার্তা’র সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে মতামত ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক ও আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের;- শিক্ষাবার্তা কর্তৃপক্ষের নয়।”
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/২৬/০১/২০২৪