হার না মানা উল্লাস এখন বিসিএস ক্যাডার
শরীয়তপুরঃ প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিলেও দমে যাননি উল্লাস পাল। সাধারণ প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ৪৩তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। ৪০ ও ৪১তম বিসিএসে মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। তবে ৪১তম বিসিএসে পাস করলেও নন-ক্যাডার আসে তার। সেই সময়ের মনের কষ্ট এখন আর নেই উল্লাসের। শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করেন এলাকাবাসী ও তার শিক্ষক।
পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, ১৯৯৪ সালে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার কার্তিকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন উল্লাস পাল। উত্তম কুমার পাল ও আন্না রাণী পাল দম্পতির তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে মেজ উল্লাস। বাবা মৃৎশিল্প ব্যবসায়ী, মা গৃহিণী। দুই হাত দুই পা ছোট ও বাঁকা নিয়ে জন্ম নেয় উল্লাস। পায়ের গঠন অস্বাভাবিক হওয়ায় ছোটকাল থেকে অন্য দশজন শিশুর মতো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারতেন না তিনি। সন্তানকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন যায়গায় চিকিৎসা করান তার বাবা-মা। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাই ভারতের মাদ্রাজে নিয়ে চিকিৎসা করান। তাতেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি উল্লাস পালের। স্থানীয় কার্তিকপুর পালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কার্তিকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা নর্দান কলেজ বাংলাদেশ থেকে এইচএসসিতেও জিপিএ–৫ পান। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গ’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৪৬৩তম হয়েছিলেন তিনি। তিনি চাকরির জন্য ৮টি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। পরে চাকরি হয় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে। ২০২৩ সালের ১ মার্চ থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক নড়িয়া শাখায় চাকরি করছেন তিনি। মোবাইল, কম্পিউটার চালনায় দক্ষ তিনি। লেখালেখি ও স্বাক্ষর সব কাজই বাম হাত দিয়ে করে থাকেন তিনি।
৪৩তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়া উল্লাস পাল বলেন, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করি। ছোট সময় অন্য শিশুদের মতো হাঁটতে পারতাম না। পরে হাঁটতে শিখেছি। ৪৩তম বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। তবে আমার অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়ার ইচ্ছা।
তিনি বলেন, নিজেকে একটু অন্য রকম লাগত। কারণ, সবাই আমার চেয়ে আলাদা। ছোটবেলা থেকেই একটা লজ্জাবোধ কাজ করত। সহপাঠীদের সঙ্গে খেলতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু সেসব কঠিন খেলা (হাডুডু, গোল্লাছুট ও ক্রিকেট) আমার দ্বারা সম্ভব হতো না। তাই আমি দর্শক। স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক অবুঝ বাচ্চারা আমার গঠন দেখে হাসি-তামাশা করত। পড়াশোনায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলাম, তাই শিক্ষকদের কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়েছি। বন্ধুদের সাহায্য পেয়েছি সব সময়। পরিবার সব সময় পাশে ছিল, নইলে এতদূর আসা সম্ভব ছিল না।
উল্লাসের মা আন্না রাণী পাল বলেন, উল্লাস আমার গর্বের ধন। সেই ছোটকাল থেকে মানুষের নানা কটূক্তি সহ্য করেও আমি তাকে পরম যত্নে বড় করেছি। আজকে তার সাফল্যের জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
উল্লাসের বাবা উত্তম কুমার পাল বলেন, একটু বৃষ্টি হলে উল্লাসকে হাত ধরে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো। কখনো কল্পনা করিনি, আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে। তার বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় আমার মনটা ভরে গেছে। তাই আমরা খুশি, এলাকাবাসীও খুশি। তিনি আরও বলেন, গ্রামের লোকজন বিভিন্ন কথা বললেও আমি হাল ছাড়িনি। উল্লাসকে চিকিৎসা ও লেখাপড়া করিয়েছি। আমার ছেলের জন্য সবাই আশীর্বাদ করবেন।
স্থানীয় অনেকে জানান, সাধারণ মানুষের চেয়ে উল্লাসের বিষয়টি আলাদা। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও বিসিএস ক্যাডার তিনি। উল্লাস এলাকার গর্ব।
কার্তিকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক তুষার কান্তি বলেন, উল্লাস পাল আমাদের স্কুলের গর্ব। উল্লাস শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ায় তার উত্তরোত্তর মঙ্গল কামনা করছি।
শিক্ষাবার্তা ডট কম/এএইচএম/১৯/০১/২০২৪